কমলাপুর রেলস্টেশনে আমি পৌছালাম ট্রেন ছাড়ার ঠিক পাচ মিনিট আগে। এইভাবে ইলেভেন্থ আওয়ারে স্টেশনে আসা আমার এর আগে হয় নায়। রাত বাজে সাড়ে দশটা। ঢাকা শহর এখনও পুরো পুরি জেগে থাকার কথা। কিন্ত কোন একটা কারনে রাস্তায় লোক কম। গাড়িও কম, জ্যাম নেই তেমন একটা, তাই পাচ মিনিট আগে পৌছাতে পেরেছি, নাহলে তাও হতনা। ঢাকাতে সেই ভাবে জাকিয়ে শীত পড়েনা। তীব্র শীত যে এইবার পড়েছে তাও না। তবুও রাস্তা ঘাট ফাকা। হয়তো মানুষ এই অল্প শীতেই কাবু হয়ে গেছে। মানুষ মানুষের মত থাক, আমি আমার কাজ এগিয়ে নেই, দূরের পথ, সাথে কিছু খাবার আর পানি নিতে হবে। রেলওয়ের ক্যাটারিং রাত বারোটা একটায় বন্ধ হয়ে যায়। আমার গন্তব্যে যেতে যেতে সকাল পেড়িয়ে যাবে। সুতরাং কিছু শুকনো খাবার রাখা ভালো। খুব দ্রুত কিছু খাবার আর পানি নিয়ে নিলাম। দূরের পথের ট্রেন তবুও খুব আধুনিক পিটি ইনকা বা সাদা কোচ না। সেই নব্বই এর দশকের গাঢ় সবুজ হলুদ কোচ। লাস্ট মোমেন্ট এর টিকেট, এসি বার্থ না, আর শীতের দিনের এসি এর কোনো প্রয়োজনও নাই। ট্রেনের কামরায় এল ই ডি সাদা বাতি নাই, হলুদ রঙ কম উজ্জ্বল বাতি, এই কম আলোর বাতি অনেকটা বিষন্নতা, নস্টালজিয়া তৈরী করে দেয়, গুমোট লাগে সব কিছু আমার কাছে। আমি তাড়াহুড়ো করে ঢুকলাম কামড়ায়, ঢুকেই মনে হল দম বন্ধ করা একটা পরিবেশে ঢুকে গেছি, কর্পুরের তীব্র গন্ধ আসছে নাকে, পুরো কামড়া জুড়ে নৈশব্দ, নিস্তব্ধতা। হাতে গোনা বারো তেরজন যাত্রী। আমি নিজের সিটে গিয়ে বসলাম, অন্য যাত্রীরা সব আলাদা আলাদা দূরে দূরে। আমি গুনে দেখলাম আমাকে নিয়ে তেরজন এই কামরায়। যীশু খ্রীস্ট এর লাস্ট সাপারের তেরো জন আমরা। কামরার সব জানালা বন্ধ। মিনিট দুয়েক বসতেই কর্পূরের আর চা পাতার তীব্র গন্ধ আমাকে আচ্ছাদিত করে ফেলল। ট্রেনের কামড়ায় কর্পূর বা চা পাতার তীব্র গন্ধ কোথা থেকে আসছে? ট্রেন ছেড়ে দিলো। আমি বেশিক্ষণ আর এই গন্ধ নিতে পারলাম না। জানালা খুলে দিলাম, জানালা দিয়ে শীতের হাড় হিম করা বাতাস আসছে। দ্রুত জানালা লাগালাম। আবার সেই তীব্র গন্ধ। আমি ঘাড়ে মাথায় পানি দিয়ে এসে বসব বলে উঠলাম। কামরার দুই ধারে দুই বাথরুম, আমি একদিকে যেতে যেতে একজন বলল- ” ভাই ওই বাথরুমে যাওয়া যাবে না, পথ বন্ধ করা আছে, কফিন যাচ্ছে লাশের,”। আমি এতক্ষণে বুঝলাম কর্পূরের গন্ধ কেন আসছে। শীতের রাত, অল্প কজন যাত্রী, দীর্ঘ পথ, সাথে লাশ, জানালা দরজা সব বন্ধ, কর্পুর চা পাতার তীব্র গব্ধ চারিপাশে, কামরা জুড়ে হলুদ অল্প উজ্জ্বলের বাতির আলো আধারী, নিস্তব্ধতা। অলৌকিক একটা যাত্রা। সব মিলে আমরা চৌদ্দ জন যার মাঝে একজনের গন্তব্য অনন্ত আধারে। সেই আধারের যাত্রার সাথে আমরা তেরো জন ক্ষনিকের সংগী। অদ্ভুত এই যাত্রা হবে জানলে আমি আজ যেতাম না। এই ধরনের পরিবেশ আমার মনোজগতে চাপ সৃষ্টি করে। অফিসে না বলে দিলেই হত, কেউ জোড়াজুড়ি করতো না। আমিই আগ বাড়িয়ে অ্যাসাইনমেন্ট টা নিয়েছি। লাস্ট মোমেন্ট এর কাজ কখনো ভাল হয়না এটা সবাই জানে কিন্ত আমার ক্ষেত্রে উল্টো হয়। লাস্ট মোমেন্ট এ যে কাজেই হাত দেই দিন শেষে দেখা যায় সেটা খুব গুছানো একটা কাজ হয়ে যায়। এই আশাতেই অ্যাসাইনমেন্ট টা নেয়া। এয়ারে যাবার সুযোগ ছিলো৷ ইচ্ছে করেই ট্রেন বেছে নেয়া, কিন্ত এই যাত্রা এমন হবে তা কে জানতো। আমি ঠিক করলাম একটা মুটামুটি ধরনের ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে যাব, ঘুম অনেকটা মৃত জগতের মতই, একবার ঠিকঠাক ঘুমিয়ে যেতে পারলেই এই লাশ, কর্পুর, অল্প আলো, বদ্ধ কামরা কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না। আমি একটা ডিসোফেন খেলাম। ডিসোফেন ঘুমের জন্য খারাপ না। কিন্ত এই বদ্ধ পরিবেশই হোক কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক আমার ঘুম আসলো না। আমারা মাঝে অদ্ভুত অনুভূতি শুরু হলো, কোন কারণ ছাড়াই মৃত্যু চিন্তা আসতে লাগলো । মানুষ মরে গেলে কি হয়, কোথায় যায়, ধর্মীয় ব্যাখ্যাই কি সঠিক কিনা এই সব এলোমেলো সব চিন্তা। কামরার সবায় নিজের মত গুটিয়ে আছে, শীতের রাত, তার উপর মৃতদেহ, জানালা দরজা সব বন্ধ, এই গুমোট ভাব সবার উপরে কম বেশি প্রভাব ফেলেছে, একজন জেগে আছে, তার কানে হেডফোন। আর একজন জেগে আছে যে একটু পর পর গিয়ে কফিন দেখে আসছে, মৃতদেহ একা ফেলে রাখার নিয়ম নেই বলেই হয়ত সে দেখে আসছে, অথবা তার খুব কাছের কেউ হবে যিনি মারা গেছে, অবশ্য কাছের মানুষ হবার সম্ভাবনা কম, কারণ তার চেহারার মাঝে শোকের ছাপ নেই। এই ছেলেটাই নিয়ম করে প্রতি আধাঘন্টা বা এমন কিছু সময় মেনে কফিন এর ডালা খুলছে, আর তখনই কর্পুরের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পরে এক অপার্থিব পরিবেশ সৃষ্টি করছে। আমি ভুলে হেডফোন আনি নাই, গান বা কোন গল্প শুনে সময় কাটাবার উপায় নাই। রাত দেড়টা বেজে গেছে, এই সময় কাউকে ফোন দিয়ে গল্প করবো তেমন উপায়ও নেই। আমি চোখ বুজে বসে আছি, যদি ঘুম ধরে। ঘুম আসছে না। এমন সময় কফিনের সাথের ছেলেটা আমার পাশে এসে বসলো। তার পোশাক থেকে তীব্র কর্পূরের গন্ধ আসছে। তার হাত সাদা ভাব ধারণ করেছে, চা পাতার গন্ধ লেগে আছে তার হাতে, গলার মাফলার এ চা পাতা লেগে আছে। মৃত মানুষের স্পর্শ তার সমগ্র দেহে, এসব নিয়ে তার ভ্রুক্ষেপ নেই, সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার পাশে এসে বসেছে, আমি তার থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছিলাম, কিন্ত কেউ যদি পাশের ফাকা সিটে এসে বসে তাকে উঠিয়ে দেবার কোন অধিকার আমার নাই। সে নিজেই কথা বলা শুরু করলো- ভাই যাবেন কোথায়?
আমি- লাস্ট স্টেশনে। আপনি কোথায় যাবেন?
ছেলেটা- আপনার আগের টা, যাবার কোন ইচ্ছা ছিলো নারে ভাই, স্যারের হুকুমে যাওয়া লাগতেছে। নাহলে এই শীতের রাতে বউ এর ওম ছেড়ে লাশ নিয়ে বের হয় কোন শালায়?
আমি- যিনি মারা গিয়েছেন তিনি আপনার কে হন?
ছেলেটা – আমার কেউ না, আমি যার আন্ডারে কাজ করি, তার শ্বাশুড়ি। হের মেয়ে বিদেশে, আইতে পারবোনা, পোলায়ও আছে বিদেশ, লাশ পচে যাবে তাই কবর দিতে নিয়ে যাওয়া। জামাই তাই আমাকে দিয়ে পাঠালো।
আমি- কেউ নেই যখন জামাই নিজে আসলেই তো পারতো।
ছেলেটা – “জামাই এর তো আর কাম কাজ নাই এই বুড়ির পিছে টাইম দিবে। হে বড় কাজের লোক, এই সব ছোট খাটো কাজের মাঝে সে নায়। টাকা খরচ করছে, আমাকে দিয়ে কবর দেয়ার ব্যাবস্থা করেছে এইতো অনেক, কোন জামাই আজকের দিনে এমনটা করে।”
আমি তার কথার জবাব দিলাম না। আমাদের বর্তমান জীবন খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে, মৃত্যু, মৃতদেহ সাথে নিয়ে আমরা অবলীলায় হাসা শিখে গেছি, মৃত্যু ব্যাপার টা খুব হাল্কা ভাবে নেয়া শিখে গেছি। অথচ এর চেয়ে ভয়ংকর পরিনতি মানুষের নেই। আমি চুপ করে আছি, ছেলেটা নিজেই আবার বলে উঠে – এই বুড়ি বেচে থাকতে হুকুম দিয়ে, ফাই ফরমায়েশ করে আমাকে অস্থির করে ফেলতো, মরেও শান্তি দিলো না। এরে নিয়ে আমাকেই যেতে হচ্ছে এই শীতের দিনে। মরে গেছে ঢাকায় কবর দিয়া দে ঝামেলা শেষ, তা না বুড়ির শেষ ইচ্ছা গ্রামে স্বামীর কবরের পাশে যেন কবর দেয়া হয়। ওরে আমার স্বামী ভক্ত রে। বেচে থাকতেও আমাকে শান্তি দেয় নায়, মইরা গিয়াও আমাকে জ্বালাতে রাখছে।
আমি চুপ করে থাকলাম, এর সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি চাচ্ছি দ্রুত এই যাত্রা শেষ হোক। ছেলেটা উঠে গেলো নিজে থেকেই। কফিনের কাছে গিয়ে থাকবে অথবা কফিনের ডালা খুলে চা পাতা দেবে। যেই অসহনীয় যাত্রা দ্রুত শেষ হোক বলে চাইছি অথচ সেই যাত্রা দীর্ঘ হতে থাকলো। কোন এক ট্রেন কে আগে যেতে দেবার জন্য আমাদের ট্রেন থেমে গেলো। আমার খুব ইচ্ছা নিচে নেমে একটু হেটে আসার, গুমোট এই পরিবেশ থেকে কিছুটা অন্তত দূরে থাকা আর কি। নামাতে যাবো ট্রেনের টিটি গেটে আমাকে আটকালো। বলল- পাগল হয়েছেন নাকি, এই জায়গায় মাঝে মাঝেই ডাকাতি হয়। ট্রেনের দরজা খোলা যাবেনা। এতক্ষন সচল যানে বসে এই গুমোট পরিবেশে ছিলাম, এখন অচল এই যানে বসে আরো বেশি অস্থির লাগতে লাগলো। মনে হচ্ছে এই যাত্রা শেষ হবে না। ক্রসিং শেষে ট্রেন ছাড়লো আবার। কিছুদূর গিয়ে জংশন স্টেশনে আবার থামলো, এখানে বেশ কিছুক্ষন থামবে, আমি এইবার নামতে পারবো। শীতের রাত বলে জংশন স্টেশনেও তেমন মানুষ নেই, আমি একটা টি স্টলে ঢুকে চা নিলাম। এক চুমুক খেয়েছি, দুর্দান্ত চা বলতে যা বুঝায় ঠিক তেমন। দ্বিতীয় চুমুক এর পরে ছেলেটা আবার আমার কাছে আসলো।
ছেলেটা – আরে ভাই কখন নেমেছেন? আমাদের বগি থেকে কেউই নামে নাই, সব শালা মরার ঘুম দিছে,। চা খাইতেছেন নাকি? ওই চাওয়ালা একটা ফাস্ট ক্লাস চা দেও।
আমি চুপ করে চা খাচ্ছি। ছেলেটা বক বক করেই যাচ্ছে। হঠাৎ সে বলল- ভাই জানেন লাশের গায়ে যে চা পাতা দেয়া হয় এই গুলা সব কিন্ত নষ্ট হয়না, ম্যাক্সিমামই ভালো থাকে, এই চা একটু কম দামে বিক্রি হয়। তার কথা শুনে আমার হাতের চায়ের কাপ কেপে উঠে। আমার গা গুলিয়ে আসে এটা শুনে। আমি চা শেষ করিনা। টাকা দিয়ে চলে আসি। দ্রুত এই বগি ছেড়ে যেতে হবে। মৃত দেহের গন্ধ শরীরে মাখতে ইচ্ছে করছে না। অনেক চেষ্টা করে বগি বদলাতে পারলাম না। বাধ্য হয়ে এই বগিতে মনের উপর চাপ দিয়ে দাতে দাত চেপে বসে থাকতে হলো। ভোর রাতের দিকে তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিলো। কখন যে লাশ সমেত ছেলেটা নেমে গেছি বুঝিও নাই। আমি ট্রেন থেকে নেমে হোটেলে উঠলাম, সব আগে থেকেই বুক করা। গীজার ছেড়ে অনেক সময় নিয়ে স্নান করছি, এই সময় মাইকিং শুনতে পেলাম- একটি শোক সংবাদ, একটি শোক সংবাদ। মৃত্যুর গল্প আমার পিছু ছাড়ছেনা। স্নান শেষ করে রেডি হয়ে অফিসে গেলাম। টানা চার ঘন্টা মন লাগিয়ে কাজ করলাম। যে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আসা সেটার কাজ প্রায় গুছিয়ে নিতে পারলাম। ছোট একটা ব্রেক নিয়ে অফিসের বারান্দায় কফি মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সাত তালার উপরে বারান্দা, তা থেকে রাস্তার সব কিছু দেখা যায়। উপর থেকে নিচের গাড়ি, রিকশা মানুষের চলাচল দেখতে ভালো লাগে। ঠান্ডা বাতাসও আসছে। রাতের সেই পরিবেশের আচ্ছন্ন ভাব টা কেটে যাচ্ছে। এমন সময় দেখতে পেলাম একটা শবযাত্রা আসছে, খাটিয়া নিয়ে জনা পঞ্চাশেক এর একটা দল। উপর থেকে খাটিয়া সমেত সেই যাত্রার দৃশ্য খুব সুখকর কিছুনা। অনন্তকালের এই যাত্রার আর এক পথিক এই খাটিয়ার মানুষ টা। সবাই সেই যাত্রার দিকে এগুচ্ছি। একটা সময় জগতের সব কিছু ছেড়ে যেতে হবে। কেউ থাকবে না আলোহীন, অন্ধকার সেই যাত্রাতে। ভুল বললাম, একজন সাথে থাকবেন, মহান সৃষ্টিকর্তা সর্বত্র বিরাজমান তিনি অবশ্যই সেই যাত্রায় আমাদের সাথে থাকবেন, যিনি মালিক তিনি যদি থাকেন তাহলে তার সৃষ্টির অন্য আর কেউ না থাকলেও হবে।