Blog

কাচপুর ব্রিজ পার হয়ে পুর্বদিকে যে বড় রাস্তাটা চলে গেছে সেটাই ঢাকা সিলেট মহাসড়ক। নামেই মহাসড়ক আদতে দুই লেনের একটা রাস্তা যার একটু দুর পর পর বিভিন্ন মোড় এবং সেই মোড় গুলোতে ছোট বাস লেগুনা হর হামেশাই যাত্রী উঠায় এবং অতি অবধারিত ভাবে জ্যাম বাধিয়ে দেয়। এই সড়কের দুই ধার দিয়েই রেললাইন এর মত সমান্তরাল ভাবে গড়ে উঠেছে ছোট বড় মাঝারি ভারী শিল্প কারখানা। এই মিল কারখানার মালবাহী ট্রাকগুলোর কারনে এই সড়ক সর্বদাই ব্যস্ত থাকে। যেহেতু বাংলাদেশ সেহেতু কল কারখানা গুলোর পরিবেশ দূষণ রোধ করবার ব্যাপারে চরম অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হয়, এই জন্যই এই সড়ক ধরে যতটা এগুবেন আপনার চোখের এবিং মানসিক প্রশান্তি আসবে না। এই ভাবে গাউছিয়া, যেটা পাইকারি কাপড়ের সবচেয়ে বড় মার্কেট সে অব্দি চলবে। গাউছিয়া তে অতিসম্প্রতি দুটো ফ্লাইওভার হয়েছে যোগ চিহ্ন এর ন্যায়। গাউছিয়ার এই যোগ চিহ্ন সদৃশ ফ্লাইওভার পার হয়েও রাস্তার দুপাশের দৃশ্য বদলাবে না। তবে গাউছিয়া মোড় থেকে উত্তর দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলে বদলে যায় চারপাশ। প্রকৃতি এখানে তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, কোল ভরা তার সৌন্দর্য এখানে। শিল্পায়ন এই দিকে এখনো থাবা মেলতে পারেনি সেভাবে।রাস্তাটা খুব বেশি চওড়া না। পাশাপাশি দুটো রিকশা বা অটো যেতে পারে। তবে রাস্তার পাশ দিয়ে রাস্তার মতই ছোট একটা খাল চলে গেছে। যে খালের গভীরতা কম হলেও টলটলে জল থাকে সারা বছর। রাস্তার পাশে মখমলের মত নরম সবুজ ঘাস আছে। সেই ঘাস পার হয়ে চাইলেই খালের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকা যায়। খালের ওপারের দৃশ্য ঋতু ভেদে বদলে যায়। কখনো বা সবুজ ধানের খেত, কখনো এক মানুষ সমান লম্বা পাট, কখনো বা চোখ জুড়ানো হলুদ সরিষা খেত। দিনের বেলা এই নিরিবিলি নয়ানভিরাম দৃশ্য দেখার জন্য তেমন মানুষ না হলেও বিকেল হতে হতে মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে। তবে লোকে লোকারণ্য হয়না। একটু ভিতরের দিকে হওয়ায় আশে পাশের মানুষেরাই শুধু আসে সময় কাটাতে আড্ডা দিতে। আমি নিজেও ছুটির দিন গুলোতে যাই। আমি একা একাই যাই। আমার মত অনেকেই একা যায়। বাইকটা রাস্তার পাশে রেখে মখমল এর মত নরম ঘাসের উপর বসে হাতে এক ঠোংগা বাদাম নিয়ে চিবাতে চিবাতে মনরোম দৃশ্য দেখে অনায়াসে বিকেল সময়টা কাটিয়ে দেয়া যায়। আমি অনেকদিন ধরে আসি এখানে। সুতরাং আমার মতই আসা কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে পরিচিতি কয়েকজন এক হলে জমাটি আড্ডা হয়। আবার মাঝে মাঝে একা থাকতে ভাল লাগে। গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম, বাসায় ভাল লাগছিলো না, তাই ভেবেছি একা একা খালের পাড়ে বসে থাকব। যেহেতু এটা ছুটির দিন না তাই ভেবেছিলাম যে ভীড় থাকবে না, আদতে কিন্তু তা হল না। মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক রকম। ভীড় আসলেও ছিল না তবে তার চেয়েও যেটা হলো সেটার চেয়ে জনসমাগম উত্তম ছিল। ভেংগেই বলি পুরোটা। গিয়ে বাইকটা রেখে বসেছি। একটা বাদাম আলা ডেকে বাদাম কিনলাম। বাদামের ঠোংগা হাতে নিয়ে পা মেলে বসেছি, আমার চোখের সামনে খালের কাক চক্ষু জল, সেটা পেড়িয়ে চোখ জুড়ানো সরিষা ক্ষেত। ছিলা ভেংগে কয়েকটা বাদাম খেয়েছি, মনরোম প্রাকৃতিক দৃশ্য অল্প অল্প করে হৃদয় জুড়ে প্রশান্তি নিয়ে আসছে ঠিক এই সময় তাকে আমি দেখতে পেলাম। দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলাম যাতে সে না বুঝে আমি দেখেছি তাকে। মনে একটা ক্ষীণ আশা সেও আমাকে দেখতে পাবে না। তবে ক্ষীণ আশা যে পূর্ণ হবার সম্ভবতা যে ক্ষীণই থাকে সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝলাম। সে আমাকে দেখেছে এবং আমার কাছেই সে আসছে। মনে যে প্রশান্তি ভাবটা আসছিল সেটা মুহুর্তের মধ্যে উবে গেল। যে আসছে তার নাম সিদ্দিকী আলম। তার ডাকনাম খোকা। আমাদের চেনা মহলে তার নাম ব্যাকা পন্ডিত। নামের শানে নযুল আছে। খোকা এর শারিরীক মানসিক এবং অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই মোটামুটি অবস্থা ভাল তা সত্তেও সে সর্বদাই হতাশাগ্রস্ত, এবং প্রচন্ডরকম এর নিরাশাবাদি। তার প্রধান এবং একমাত্র গুন সে তার হতাশা এবং নেগেটিভিটি অতি অল্প সময়ের মাঝে আশে পাশের মানুষের মাঝে শেয়ার ইট অ্যাপ এর মতই ছড়িয়ে দিতে পারে। মানুষের একটা স্বভাব হলো সে অন্য মানুষের বিপদের সংবাদে প্রীত হয় কিন্তু অন্য মানুষের হতাশার গল্প সে নিতে পারেনা। হতাশা ব্যাপারটা সকলের মাঝেই খাচায় আটকে থাকা সিংহের মত পড়ে থাকে হঠাৎ করেই অন্য কারো হতাশার গল্প সেই খাচার তালার চাবি কাজ করে। এবং অন্য কেউ হতাশার গল্প করলে অতি অবশ্যি নিজের ভেতরের খাচা খুলে গিয়ে নিজের হতাশাও বাইরে বেড়িয়ে পরে। তাহার দ্বিতীয় গুন হল যে কোন বিষয়ে সবায় যেটা বলবে সেটার এগেইনেষ্ট এ মত দেয়া এবং সেই মত কে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য সত্য মিথ্যা বিভিন্ন তথ্য প্রদান করা। আমরা যেহেতু সকলেই মোটামুটি ভাবে ত্রিশ এর কোঠাতে চলে এসেছি তাই তাকে সরাসরি ভাবে অপমান বা হেয় করি না। তবে তার কথায় তাল দিয়ে নাচি না। তাকে এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করি, যদিও মানুষের পিছনে তার দোষ গুন আলোচনা করা ঠিক না তবুও তাকে নিয়ে আমাদের পরিচিত মহলে বেশ সমালোচনা হয়। তবে তার সংগ কেউ পছন্দ করেনা। আমিও ব্যক্তিগত ভাবে তাকে পছন্দ করিনা। তবে কেউ সামনা সামনি আসলে তো তাকে এড়ানো যায় না। উনি এসে আমার পাশে বসলেন। কুশল বিনিময়ের পরে শুরু হল তার হতাশার গল্প। আমি মনে মনে ঠিক করে নিলাম আজকে উনাকে কিছু কড়া কথা অন্য ভাবে শোনাতে হবে। উনি যেহেতু বুঝে নায় যে আমার মুড খারাপ আছে সুতরাং সে তার স্বভাব অনুযায়ী কথা শুরু করল।

খোকা – ভাই একা একা বসে আছেন, কাজ কাম নাই নাকি?

আমি – না কাজ আছে। আজকে ছুটি নিয়েছি। আপনি নিজেও তো একা এসছেন, আপনার কাজ টাজ নাই।

খোকা – আমি কি আর ভাই আপনাদের মত নাকি, আমি অফিসের চাপে শেষ হয়ে গেলাম। আমার তো ছুটিই মিলে না। আর এমনই চাকরি ছুটি দেয় না।

আমি- ছুটি দেয়না বুঝলাম, আজকে তাহলে কি ভাবে বের হয়েছেন?

খোকা ভাই এর মুখ আমার এই কথা শুনে পাংশু বর্ণ নিল। অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে তিনি বললেন-‘অনেক কষ্টে আজকে ছুটি নিয়েছি। অফিস জীবনটা তামা তামা করে দিল।’

আসল অবস্থা মোটেও তেমন না। তিনি বেশ ভালোই আছেন, ভাল বেতন পান, ছুটি ছাটাও মন্দ না। কিন্তু ওনার স্বভাবটাই অমন। আমিও মনে মনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলাম আজকে খোকা মহাশয় কে একটু রগড়ে দিতে হবে। আমি বললাম

আমি- ভাই আপনার এত দুঃখ কেন বলেন তো? সব সময়ই দেখি কোন না কোন কিছু নিয়ে আপনি দুঃখিত। আসলে সমস্যা কোথায়?

খোকা- আপনার বয়স কম আপনি কি আর বুঝবেন এই সব?

আমি- বয়স আপনার থেকে কম ঠিক আছে তাই বলে খুব যে কম তাও তো না। আপনি বুঝায়ে বললে বুঝবো না এমন গাধা টাইপ ও না। আপনি বলেন।

খোকা- ভাই অনেক দিন হল চাকরি করি, টাকা পয়সা মন মত পাইনা, ছুটি নায় তেমন, এখনো ম্যানাজারিয়াল পোস্ট পেলাম না। এখনো পারসোনাল গাড়ি পেলাম না। কত আফসোস আছে রে ভাই। সব কি আপনাকে বলা যায় নাকি।

আমি- ভাই সময় মত সবই পাবেন। পারফরম্যান্স ছাড়া বড় পোস্ট কিভাবে পাবেন। আর থাকেন তো অফিসের পাশে। পারসোনাল গাড়ি দিয়ে আপনি কি করবেন। পরে দেখা যাবে অফিস থেকে দেয়া পারসোনাল গাড়ি আপনি নিজে ইউজ না করে রাস্তায় খ্যাপ খাটাচ্ছেন।

খোকা সাহেব আমার কথাতে যে প্রীত হন নায় সেটা তার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝে গেলাম। তিনি একটা দীর্ঘ নিঃশাস নিয়ে বললেন- ‘এই জন্যই আপানাকে বলা বৃথা। বুঝেন কম কথা বলেন বেশি।’

আমি – ভাই রাগ কইরেন না। আমি বুঝি কম কথা বলি বেশি ঠিক আছে, আর আপনি বুঝেন বেশি কথা বলেন অতিরিক্ত বেশি। বেশির থেকে অতিরিক্ত বেশি আরও বেশি ক্ষতিকর।

আমার হেন জবাবে তার মেজাজ খারাপ হল স্বভাবতই। কথা বাড়ালে যে আমার কাছ থেকে আরো বেশি হিউমিলিয়েট হতে হবে এটা মনে হয় তিনি খানিকটা আচ করতে পেরেছেন তায় অবস্থা একটু স্বাভাবিক করবার নিমিত্তেই হয়ত বললেন-‘আচ্ছা ভাই বলেন তো টিভি নাটক সিনেমায় যেমনটা দেখা যায় মানে, সুটেড বুটেড হয়ে ঢুকবেন গাড়ি নিয়ে, একটু ল্যাপটপ টেপাটেপি করবেন, এক কাপ কফি খেয়ে গার্লফ্রেন্ড কে ফোন দিয়ে বলবেন মিটিং এ যাচ্ছি। আধা ঘন্টা প্রজেক্টর এ স্লাইড দেখবেন এরপর কোনো দামি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে অফিস শেষ। এমন জব কিভাবে কেমনে পাওয়া যায় বলেন তো।’

আমি- এফডিসিতে শুটিং ফ্লোরে পাবেন আর উত্তরার শুটিং বাড়ি গুলাতে পাবেন। খুব ইচ্ছে হলে এই দুই যায়গায় গিয়ে সিভি দিয়ে আইসেন।

খোকা- ভাই মজা করেন কেন? সিরিয়াস ভাবে জানতে চাইতেছি, জানা থাকলে বলেন না জানা থাকলে বলেন জানি না।

আমি- আচ্ছা বলছি তার আগে যা যা জিজ্ঞাসা করব ডিরেক্ট এন্সার দিবেন।

খোকা- হুম বলেন

আমি- জসীম কে আপনার নায়ক হিসেবে কেমন মনে হয়?

খোকা- চাকরির সাথে জসীম কিভাবে রিলেট করছে এটাই বুঝলাম না।

আমি- কথা প্যাচাতে আগেই মানা করেছি। ডাইরেক্ট এন্সার দেন।

খোকা- আচ্ছা বলছি। জসীম কে নায়ক হিসেবে আমার মনেই হয়না, ইয়া মোটা গাব্দা, তার উপর কাপালিকের মত গোফ, পেট দেখলে মনে হবে পাচ মাসের প্রেগন্যান্ট।

আমি- একটা মানুষের এত দোষ বের করলেন তাও সে নায়ক, এবং মাক্সিমাম সিনেমায় গরিব ছোট লোক, তার পরে ঠেলা গাড়ি ঠেলে, গতর খাটায়ে কোটিপতি হয়ে যায়। আবার বড়লোক হয়েও দান করতে করতে আবার গরিব হয়ে যায়। এর মত লোক লটারি কাটলেই ফাস্ট প্রাইজ ও পেয়ে যায়। বুঝেন অবস্থাটা। যারে পছন্দ করেন না নায়ক হিসেবে সে সব কিছু করে ফেলে। কোথায় করে? সিনেমার মাঝে করে। যে চাকরি আপনি চান সেটা তাই সিনেমাতেই হবে।

খোকা- ধ্যাত কিসের সাথে কি মিলাচ্ছেন।

আমি- ঠিকই মিলাচ্ছি। আপনি নিজেও তো মোটাতাজা আছেন। ভারী গোফ রাখলে আপনাকেও জসীমের মতই মনে হবে। পেটটা নিয়ে আর একটু মেহনত করেন। খাওয়া দাওয়া বাড়িয়ে দিয়ে এখন যা আছে এর চেয়ে আরো বড় করেন। এখনতো তিন মাসের পেট মনে হয়। খেয়ে দেয়ে এটাকে ছয় মাসের বানায়ে ফেলেন। বললেন জসীমের পাচ মাসের পেট। আপনি ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট হয়ে এফডিসিতে যাবেন। বাংলা ছবির ডিরেক্টররা আপনাকে নতুন জসীম ভেবে লুফে নেবে। তখন আপনার নিজের পছন্দের টাইপ এর অফিসও করতে পারবেন।

খোকা ভাই আমার কাছে এই রুপ ভৎসনা আসা করেন নায় কল্পনাতেও। উনার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। আমাকে কিছু কড়া কথা বলবেন এমন প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে সেই সু্যোগ না দিয়ে আমি বললাম- ‘ভাই নাটকের ক্যামেরার কাজ করে এমন একজন আমার পরিচিত আছে। তার সাথে আপনার কথা বলায়ে দেই। আপনি তার সাথে এফডিসিতে দেখা করেন। ‘

খোকা ভাই আর কোন কথা বললেন না। রাগে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়লেন। এবং কোন বিদায় সূচক কথা না বলেই হাটা ধরলেন। আমি মনে একটা প্রশান্তি পেলাম। কয়েকটা ফড়িং উড়া উড়ি করছে, ঘাসের ডগায় বসছে তবে বসেই উঠে যাচ্ছে। আমি সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম যদি কোন ফড়িং যদি হাতের উপর বসে তাই। ফড়িং এরা আমার হাতে বসে না। তারা ঘাসের উপর বসে, মাঝে মাঝে খালের স্বচ্ছ জল স্পর্শ করেই ফিরে এসে উড়ে বেড়ায়। আমি বাদামের খোসা ভেংগে মুখে দেই। বিটনুনের সাথে বাদাম খেতে ভালোই লাগে। আস্তে আস্তে বেলা পরে আসে। আমি রাস্তা থেকে নেমে খালের কাক চক্ষু জলে পা ডুবিয়ে বসি। খালের কমনীয় শীতল জলের মৃদু স্রোত আমার পায়ের উপর দিয়ে বয়ে যেতে থাকে। আমি দীর্ঘ সময় পা ডুবিয়ে বসে থাকি। সূর্য অস্ত যায়। আমি তবু্ও বসে থাকি একটা সময় আকাশ ফুটে সাদা থালার মত চাঁদ বের হয়। তার অবয়ব খালের জলে পরে। মনে হয় কত কাছে চাঁদটা। খালের স্বচ্ছ জলে হাত দিয়ে সেই চাঁদটা ছুয়ে দেখবার সাধ জাগে। কিন্ত তা কখনই ছুয়ে দেখা হয়না। মানুষের কটা সাধই বা পূরণ হয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *