Blog

সকাল থেকেই তীব্র বৃষ্টি হচ্ছে। খুব বেশি বৃষ্টি হলে স্কুলে রেইনী ডে বলে ছুটি দেবার একটা চল আমাদের সময় ছিল। এক দশকের উপরে হয়ে গেছে স্কুল ছাড়ার। এখনো রেইনী ডে নামক ছুটির সেই চল আছে কিনা জানি না। তবে ঢাকা শহরে যারা চাকরি টাকরী করে খায়, তাদের জীবনে রেইনী ডে নামক ছুটির আশা করা বোকামীর সর্বশেষ লেভেল এর কাজ। আমি যেহেতু চাকরি করি তাই আমার মনে সকাল থেকেই বৃষ্টি দেখে চিন্তা অফিস কিভাবে যাওয়া যায়। বৃষ্টি বাদলার দিনে ঢাকা শহরে প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট ছাড়া চলাচল করা খুব কঠিন ব্যাপার। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় দেখা যায় ভরা নদীর থই থই জল, আর অলি গলি তে প্যাচ প্যাচে কাদা পানি, গাড়ির তীব্র জ্যাম জট ফেলে গন্তব্যে পৌঁছানো অলিম্পিকে সোনা জয়ের মতই দূরহ। আর বৃষ্টি বাদলার দিনে ঢাকা শহরের রিকশা ওয়ালা, সি এন জি ওয়ালাদের ভাব আকাশ স্পর্শ করে। তাদের সাথে কথা বললে মনে হবে তারা রিকশা না হেলিকপ্টার চালায়। যদি তাদের জিজ্ঞেস করেন -“মামা যাবেন”? তারা প্রথম একবার জিজ্ঞেস করায় উত্তর দেবে না। টানা দুই তিনবার জিজ্ঞেস করবার পরে উদাস একটা দার্শনিক ভাব নিয়ে বলবে – “যাব না”। তখন তাদের কে বার কয়েক নরম গলায় অনুরোধ করতে হবে, ভারা দ্বিগুন তিনগুন এর লোভ দেখাতে হবে এর পর তিনি আড়মোড়া ভেংগে বলবেন -“আচ্ছা চলেন, একটু খাড়ান একটা সিগারেট খাইয়া লই।” সুতরাং তীব্র বৃষ্টি দেখে আমার মাঝে টেনশন কাজ করবে এটা জানা কথা। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। টেনশন বেশিক্ষন করতে হলনা। অফিস থেকে কলিগ ফোন দিল- “ভাই গুড নিউজ আছে, আজকে বস অফিসে আসবে না। আমি নিজে কথা বলেছি, যে বৃষ্টি তাতে আজকে অফিসে না গেলেও হবে।”

আমি- ভাই সকাল সকাল জোকস করছেন নাতো?

কলিগ- ধুর মিয়া, জোকস কেন করবো, আসলেই যেতে হবে না। গুড নিউজ দিলাম, নেক্সট ডে তে আমাকে একটা কফি খাওয়াবেন।

আমি- ওকে ব্রাদার।

মনের মাঝে একটা সুখি সুখি ভাব এলো। ঠান্ডা ওয়েদার, সুন্দর ঘুম দেয়া যাবে। বিকেলের দিকে বৃষ্টি বাদলা না থাকলে হানিফ মামার টংয়ে আড্ডা দিতে যাওয়া যাবে। আমি বিছানায় গড়ান দিলাম আবার। এগারোটার দিকে ঘুম ভেংগে গেল। বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস নাইতো তাই ঘুম হলোনা। আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাশতা নিয়ে বসলাম। সাথে আজকের পত্রিকা। পত্রিকা তে ইন্টারেস্টিং তেমন কিছু পড়ার নেই। নিজের মাঝে ব্যোমকেশ ভাব আনবার জন্যই বিজ্ঞাপন এর পাতায় চোখ বুলাচ্ছি। শরদিন্দু এর ব্যোমকেশ এর একটা গল্পে ব্যোমকেশ বলেছিল পত্রিকার আসল ব্যাপার থাকে বিজ্ঞাপনের পাতায়। আমি সেই ফরমুলা মানছি। বিজ্ঞাপন এর পাতায় একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেল। “আপনি কি ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত?” আমি কেন ঢাকা শহরে প্রাইভেট চাকরি করা শতকরা নিরানব্বই ভাগ মানুষ ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত। এটা একটা স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান এর বিজ্ঞাপন। তারা বেকার স্বকার সবাই কেই কর্মদক্ষতা রিলেটেড কিছু কোর্স করায়। আজকে তাদের একটা ফ্রি সেমিনার আছে। তাদের কাছে কোর্স করলে বেকার রা চাকরি পায়, স্বকার দের চাকরির উন্নতি হয়। লোভনীয় বিজ্ঞাপন। তাদের ঠিকানা দেখলাম। আমার বাসার পাশেই। মনের মাঝে একবার ইচ্ছা হল আজকে বিকেলে হানিফ এর টংয়ে না গিয়ে সেমিনার ঘুরে আসলে কেমন হয়। তবে হানিফ এর টংয়ে জমাটি আড্ডা হয়, হানিফের টংয়ে এর ভাজাভুজির টেস্ট অসাধারণ, হানিফের চিকেন পাকোড়া এর টেস্ট অমৃতসম। তাই সুযোগ থাকলে হানিফের তেলেভাজা আর আড্ডা ত্যাগ করা এক ধরনের ক্রাইম মনে হয় আমার কাছে। তবে ক্রাইম টা আজকে করতে হবে, টাকা পয়সা যখন লাগছে না তখন সেমিনার অ্যাটেন্ড করা যেতে পারে। আফটার অল ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কে না চায়।

বিকেল হতে হতে বৃষ্টি ছেড়ে দিল। আকাশ ফরসা। আমি বের হলাম। রিকশা নিয়ে টাইম মত পৌছে গেছি। যে উতসাহ নিয়ে এসেছি তা দমে গেলো। যারা এসেছে ম্যাক্সিমাম সুটেড বুটেড ফরমাল পোশাকে এসেছে। আর আমি গাধা এসেছি জিন্স আর পোলো শার্ট পরে। শেখ সাদী পোশাক রিলেটেড গল্পটা মাথায় নিয়ে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি আর মনে মনে আমার মতোই ক্যাজুয়াল ভাবে আসা কাউকে খুজছি। বেশিক্ষন খুজতে হলো না। আমার মতোই আরো কয়েকটা গাধা ঢুকলো। এদের চোখের দৃষ্টিতে বিভ্রান্ত ভাব আছে, চেহারার মাঝে হতাশা হতাশা ভাব। দেখে মনে হচ্ছে এরা বেকার। যারা এসছি তারা নাম এন্ট্রি করে সেমিনার রুমে ঢুকে গেলাম। সেমিনার রুমটা বেশ ভাল করে সাজানো, এসি আছে। রুম স্প্রে করা, মৃদু একটা মোহনীয় সুবাস ছড়িয়ে আছে ঘরময়। সেমিনার এর এর বক্তা কয়েকজন, এরা কথা বলার স্কিলে সোলাইমান সুখনের মত দক্ষ। ঝাঝালো মোটিভেশান দিল। যে গুলো শুনলে মনে হবে লাইফে শাইন করা বেশ ইজি যদি এই খানের কোর্স গুলা করা যায়। মোটিভেশান এর পরে আসলো তারা কি কি শেখাবেন, কত কি খরচ পড়বে সেগুলোর আলোচনা। এর পর আর এক প্রস্থ মোটিভেশান। এর পর তারা সেমিনারে অ্যাটেন্ড করা দের ইনফরমেশন কালেক্ট শুরু করলেন। এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল, কিন্তু এর পরের পর্ব টা আমার জন্য কঠিন হয়ে গেলো, তারা আগন্তুক সকলকেই মিনিট দুয়েক সময় দিলেন তাদের নিজের সম্পর্কে একটা ইন্টোড্রাকশন দেবার জন্য, এবং প্রত্যেকেই তার সাথে জীবনের একটা অ্যাচিভমেন্ট বলতে হবে। কোন প্রকার প্রিপারেশন ছাড়া ইনট্রো দেয়া আমার জন্য ইম্পসিবল এবং আমার লাইফে বলার মত কোন অ্যাচিভমেন্ট নেই। সামনের সারি থেকে শুরু হল। আমি মাঝামাঝি, আল্লাহ আল্লাহ করছি, যাতে আমার পর্যন্ত আসতে আসতে সেমিনার টাইম ওভার হয়ে যায়। সুটেড বুটেড ফরমাল যারা এসেছেন এদের ইনট্রো শুনে মনে হচ্ছে এরা নিজেরাই ক্যারিয়ার রিলেটেড সেমিনার অ্যারাঞ্জ করতে পারে হুদাই এরা কি শেখার জন্য আজকের এই সেমিনার অ্যাটেন্ড করেছে আল্লাহ মালুম। কনফিডেন্ট সব মানুষ দের মাঝে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হতে লাগলো। আমি কি বলবো তা মনে মনে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছি। কিন্ত আওলা ঝাওলা হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এমন সময় খুব ক্যাজুয়াল একটা ছেলে দাড়ালো। তার পরণে মেরুন রঙের টি সার্ট, সাথে নীল গ্যাবাডিন প্যান্ট। মাথায় চুল কম, মুখে কয়েকদিনের সেভ না করা দাড়ি। সে দাড়িয়েই অন্য সব সুটেড বুটেড দের মত ইন্ট্রো দিলনা। সে বলল- ” আমি সাগর, কিন্তু সাগরের বিশালতা আমার নাই, সমুদ্র ঠিক যতটা বড় আমি ঠিক ততটাই ক্ষুদ্র। আমি অর্থনীতি তে আন্ডারগ্রাড করেছি। আমার জীবনের একটা না দুইটা অ্যাচিভমেন্ট বলবো। প্রথমটা হল – আমি বুঝেছি একাডেমিক পড়াশোনা করে আমি কিছু করতে পারবো না, দ্বিতীয় – পৃথিবীতে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু হল টাকা। তাই আমি প্রথমটার পিছনে ছোটা বাদ দয়ে দ্বিতীয়টার পিছে ছোটা শুরু করলাম এবং চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ হলাম। কিন্ত কথা হলো..

ছেলেটা কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই প্রোগ্রামের অ্যাংকর বললেন- “মিস্টার সাগর, এটা ফান করার জায়গা না, একটার জায়গায় দুটো অ্যাচিভমেন্ট এর নাম করে আপনি পুরো ব্যাপারটা ফানি বানিয়ে ফেলছেন।”

সাগর- সরি স্যার, আমার মনে হয় আমি ঠিকই বলছি, একটু আগেই আপনার মোটিভেশনাল স্পিকার বলেছেন, নিজের সামর্থের ব্যাপারে ভাল ধারনা থাকতে হবে, নিজের দ্বারা কোনটা হবে কোনটা হবে না সেটা আগে বুঝতে হবে, নিজেকে বুঝতে পারা সব চেয়ে কঠিন ব্যাপার। আমি তাই আমার দ্বারা কি হবে না হবে সেটা বুঝতে পেরেছি, এটা কি অ্যাচিভমেন্ট নয় নাকি?

অ্যাংকর- আপনি আপনার লাইফের ম্যাটেরিয়ালিস্টিক অ্যাচিভমেন্ট বলেন, ভাবগত কথার জায়গা এটা না।

সাগর- ম্যাটেরিয়ালিস্টিক অ্যাচিভমেন্ট যদি বলি তাহলে তো বলতে হবে দুপুরে মুরগী দিয়ে ভাত খেয়েছি, ঢাকা শহরে অনেকেই না খেয়ে আছে, সেই হিসেবে এটাও অ্যাচিভমেন্ট।

ছেলেটার এই কথা শুনে আমরা ম্যক্সিমাম সবাই হেসে দিলাম। এর মাঝে কিছু ছেলে যারা আমার মত ক্যাজুয়ালী এসেছে এরা রীতিমতো ইচ্ছা করেই উচ্চস্বরে হা হা হি হি হো হো শুরু করলো। পুরো সেমিনার হলের ভারি পরিবেশ নিমিষেই নষ্ট হলো। অল্প কয়েকজন যারা সুটেড বুটেড এসেছে তাদেএ মাঝে একটা একটা গম্ভীর ভাব, তারা এই সব নিম্নশ্রেণীর কথা বার্তাতে বিরক্ত। হাসা হাসি একটু থামলে সাগর মিয়া নিজে থেকেই আবার বলল- আমি আন্ডারগ্রাড কোর্সে বেশ কয়েকবার ব্যাকলগ খেয়েছি, আই মিন ফেল করেছি, একবার ব্যাবসা করতে গিয়ে ধরা খেয়ে ক্যাশ ক্যাপিটাল যা ছিল সব গেছে, একদিন না খেয়ে থাকা লেগেছে। এটাও অ্যাচিভমেন্ট কজ আপনার মোটিভেশনাল স্পিকার বলেছে, ফেইলুর ইজ দা পিলার অফ সাকসেস।

আবার হাসাহাসির রোল পরে গেল। কেউ একজন হাত তালি দিলো সাথে সাথেই হাত তালির রোল পরে গেলো। আমি নিজেও জোরে জোরে হাত তালি দিলাম। আয়োজক বুঝে গেলেন এই সেমিনার কন্টিনিউ করা বৃথা, উনারা দ্রুত প্রোগ্রাম শেষ করলেন। সবাই বের হয়ে গেল। আমি বের হয়ে সাগর কে খুজছি। এই ছেলেটার কথা বার্তা আমার ভাল লেগেছে, এরে নিয়ে হানিফ এর টংয়ে বসে তাকে একটা স্পেশাল মালাই চা খাওয়াতে হবে সাথে চিকেন পাকোড়া। কিন্ত বের হয়ে তাকে আর পেলাম না। কোথায় গেল সে? বেশ কিছুক্ষন খুজলাম, পেলাম না। দু একজন কে জিজ্ঞেসও করলাম, কেউ বলতে পারলো না। আসলে তাকে পাওয়া যাবেনা। মহাপুরুষ ধরনের ছেলে বলেই, এই ভাবে কথা বলতে পেরেছে, মহাপুরুষ রা মাঝে মাঝে দেখা দেন, দৈব দু একটা বানী দিয়ে আবার উধাও হয়ে যান। তাই ছেলেটাও উধাও হয়ে গেছে। আমার মত ক্ষুদ্র মানুষ মহাপুরুষ এর সান্নিধ্য কিভাবে আর পাবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *