রেস্টুরেন্টটা বেশ সুন্দর, ছিম ছাম। পুরোটা জুড়েই সবুজের ক্যারিকেচার। মাঝে মাঝে ছাত থেকে ছোট ছোট চোখ জুড়ানো সব ঝাড়বাতি। সেই আলো তত তীব্রতা ছড়াচ্ছেনা। আলো আধারীর মত নয়, আবার উজ্জ্বল চোখ ঝলসে যাবে এমনও নয়। নয়ন জুড়ে মৃদু সুখ এনে দেয় এমন আলোর কাজ। প্রতিটা টেবিল, চেয়ার, ফর্ক, স্পুন রাখার ছোট টেবিল র্যাক এতো টাই বেশি সুন্দর করে সাজানো গোছানো যে মনে হবে না এই গুলোতে খাবার বেড়ে দিক ওয়েটার। বরং খাবারের এই আনুষাঙ্গিক জিনিস গুলো দেখে মনে হচ্ছে এই গুলো শোভা বাড়ানোর জন্যই রাখা। সাইডে বাচ্চাদের খেলার জন্য বেশ বড় স্পেস আছে, সে জায়গাও যথেষ্ট গোছানো এবং পর্যাপ্ত খেলনা দ্বারা পরিপূর্ণ। এতো ভালো একটা পরিবেশে বসে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। আমি বসেও আছি অনেকটা সময় ধরেই। তবে মনের মাঝে শান্তি নেই। জগতে সমস্যা ব্যতিত আর কোন কিছুর সমাপ্তি তে আনন্দবোধ থাকে না। আজকে এই যে এই খানে বসে আছি বেশ কিছুটা সময় সেটা নাজিয়ার জন্য। এটা ওর আর আমার আনুষ্ঠানিক শেষ সাক্ষাত। জগতে শেষ দেখা হয় দুই ধরনের। এক, কেউ মারা গেলো আর দুই আপনি মন থেকেই চাইবেন না যে তার সাথে আপনার আর পরবর্তী সময়ে দেখা হোক। নাজিয়ার সাথে আমার দ্বিতীয়টা ঘটছে। নাজিয়া কে জানেন? সে আমার স্ত্রী। তার সাথে আমার সাড়ে চার বছরের সংসার জীবন। জানা শোনা বছর পাচেকের। মাস ছয়েক উথাল পাথাল প্রেম চলেছে, এরপর বিয়ে। তার সাথে আমার পরিচয় বেশ অড একটা প্লেসে। বাংলা মোটরের একটা বেশ ভালো বার এ আমি একদিন একা গিয়েছি ড্রিংকস করার জন্য। কোন একটা কারণে খুব মন খারাপ ছিল বলেই একা একা যাওয়া। একা গিয়েছিলাম বলেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ চলে গেলেও তা দেখবার বা বুঝাবার কেউ ছিলো না। একের পর এক পেগ নিয়ে গেছি। একটা সময় বার বয় নিজে থেকেই থামতে বলল। আমি শুনলাম না। আরো বার দুয়েক পেগ নিয়ে আমি বেশামাল হয়ে গেলাম। বার ভর্তি পানরত মানুষের মাঝে ওয়াক করে বমি করে দিলাম। বার বয় থেকে শুরু করে সবাই ভতসনা শুরু করল অথচ এদের এমনটা করার কথা না। বরং” স্যার কোন সমস্যা” বলে এগিয়ে আসার কথা। কিন্ত তাদের কথা না মেনে একের পর এক যখন পেগ নিয়ে গেছি তখন উউল্টোপাল্টা কিছু ঘটলে হিউমিলিয়েশন মেনে নিতেই হবে। আমি অনেক চেষ্টা করে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারছিলাম না। বিশ্বাস, মমতা নিয়ে কেউ যে পাশে এসে দাঁড়াবে বা মাথায় হাত রেখে বলবে “বেশি খারাপ লাগছে কি?” এমনটা কেউ বলছে না। বার বয় ক্লিনার কে ডাকছে। আমি বসা অবস্থা থেকে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো এমন মনে হচ্ছে৷ ঠিক এই সময় কে যেন আমার পিঠে হাত দিলো, তার কিন্নরী কন্ঠ শুনলাম – “আপনি একটু চেষ্টা করে ভালো ভাবে বসুন তো, সালাট এর বোল থেকে তেতুলের যে টক টা আছে সেটা মুখে দিন। এরপর একটু ঠান্ডা বরফ মুখে দিয়ে দিন” । তার কিন্নরী সেই কন্ঠের যাদুতেই হোক অথবা কেউ একজন পাশে এসেছে এই কারনেই হোক আমি কিছুটা স্ট্যাবল হবার চেষ্টা করলাম। মেয়েটার কথা মত কাজ করলাম। মিনিট পাচেক বাদে আমি পুরোটা না হলেও মোটামুটি ধাতস্থ হয়ে গেলাম। ঢাকা শহরের বারে আমি প্রচুর মেয়েকে মদ খেতে দেখেছি৷ ছেলে মেয়ের প্রকাশ্যে ঢলাঢলি, লদকা লদকিও কম দেখি নাই। কিন্ত বারের মধ্যে বমি করে ভাসিয়ে দেয়া কোন যুবকের পাশে সুশ্রী কোন মেয়ে এসে দাড়িয়েছে, তার সাথে দু দন্ড কথা বলে তার মননে, শরীরে শীতল পরশ বইয়ে দিয়েছে এমনটা দেখি নাই। মেয়েটা তার বন্ধু বান্ধব দের ছেড়ে আমাকে বাড়ি পৌছে দিল। তার নিজের ঠিকানাও আমার বাসার দিকে হওয়ায় সে অবলীলায় আমার সাথে চলে এলো। সেই যে এক সাথে এলাম, এরপর নানা ভাবে বিভিন্ন সময় যোগাযোগ হতে হতে তার সাথে আমার গভীর প্রেম হয়ে গেলো। অল্প দিনেই বিয়ে করে ফেললাম। নাজিয়ার বাড়ি থেকে তীব্র আপত্তি ছিল আমাকে নিয়ে। তারা চেয়েছিলেন বিদেশী সেটেল্ড পাত্র। বিয়ের বছর তিনেক বেশ ভালোই কাটলো, এরপর থেকে কিভাবে কিভাবে যেনো সব এলো মেলো হতে লাগলো, তার সাথে আমার প্রতি কথাতে ঝগড়া লেগে যায়। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারি না। কিছুদিন একে অন্য থেকে দূরে থাকবো বলে আলাদা বাসা নিলাম। কথায় বলে দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়। আদতে হলো তার উল্টো। সে ছাড়া আমি আর আমি ছাড়া সে বেশ স্বছন্দ জীবন পেলাম। দূরত্ব বাড়িয়ে দিলো, আরো বেশি দূরত্ব৷ সামাজিকতার ভয়ে আবার এক সাথে উঠলাম। একা জীবনে ততদিনে স্বছন্দ হয়ে ওঠা দুজনেই আমরা এবার আরো বেশি ঝামেলা মনে করতে লাগলাম একে অন্যকে। আমার মাথায় শুধু একটা ব্যাপারই ঘোরে- একটা মানুষের সাথে বছরের পর বছর এক ঘরে এক বিছানায় কিভাবে থাকে মানুষ? এভাবে বেশি দিন গেলো না। আমরা দুজনেই মিউচুয়ালী ডিভোর্স ফাইল করলাম। সব কিছু অল্প দিনেই হয়ে গেলো। চুড়ান্ত বিচ্ছেদের আগে তার সাথে শেষ কিছুদিন একসাথে ছিলাম। কোন কথা হতো না। ও ওর মতো আমি আমার মতো চলতাম। এই দিন পনেরো আগে যখন বুঝে গেছি বিচ্ছেদ টা কাগজে কলমে চূড়ান্ত হয়েই যাচ্ছে তখন আলাদা হয়ে গেলাম৷ গত দু দিন আগে সব কিছু হয়ে গেলো। আজ এসেছি তার সাথে শেষ বার দেখা করতে। ডিভোর্স এর পর বিয়ে করা স্ত্রীর সাথে যেন আর দেখা না হয় এই কামনাই বেশি ভাগ মানুষই করে। নাজিয়া চলে এসেছে। তার পড়নে কালো রঙের জামদানি, তাতে খয়েরী পাড় দেয়া। চুল খোলা। এই মেয়ে ম্যক্সিমাম সময় জিন্স, কাতুয়া, টি শার্ট, টপ, স্কার্ট পড়, আজকে কি মনে করে শাড়ি পড়ে এসেছে? তাকে এই রুপে যে দেখবে সেই প্রেমে পড়ে যাবে। আমি তার সঙ্গ অপছন্দ করি তবুও শাড়ি পড়া তাকে দেখে নড়ে চড়ে বসলাম। সে আমাকে দেখে হাসলো না। দেরী করে এসেছে বলে স্যরি ও বলল না, এসেই বসে পড়লো আমার সামনের চেয়ারে এরপর বলল-” ভালোই হলো তাইনা, তুমি স্বাধীন হয়ে গেলে, এখন পুরোপুরি একা একা শান্তিতে থাকবা, কেউ নেই কিছু বলার।”
আমি- তা ঠিক। আমি একা তো না, তোমার জন্যও তো ভালো হলো। বর ছেড়ে দিচ্ছ, সোস্যাল মিডিয়ায় এখন টুক টাক সাহসী লেখা লেখি করলে ফেমিনিস্ট হিসেবে নাম করতে পারবা।
সে হাসে, অন্য দিন তার হাসি দেখলে আমার ভিতর পর্যন্ত জ্বলে যেতো, আজকে কেন যেন বুকে ব্যাথা লাগছে, এই সুন্দর মেয়েটা গত দুই দিন আগে থেকে আর আমার না। সে হাসতে হাসতেই বলে- আমি ফেমিনিস্ট হিসেবে নাম করলে তোমার বুঝি বুকে চিন চিন করবে, বুকের ব্যাথা ভুলতে তোমার তো জিন, রাম ভদকা আছেই।
আমি- তুমি এই দেশের প্রেসিডেন্ট হলেও আমার বুক মাথা কোন কিছুই চিন চিন করবে না।
নাজিয়া- আচ্ছা আচ্ছা বুঝছি, তারপর এখন প্লান কি? বিয়ে টিয়ে করবা নাকি আবার? নাকি অফিসের শায়লার সাথে জাস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে চলে যাবে বাকীটা দিন? এক কাজ করো কিছুদিন শায়লা, আনিকা বাদ দিয়ে একা একা থাকো দেন আবার ফিরে এসে আমাকে বিয়ে করে ফেলো। এটা বলেই সে হাসতে থাকে।
রাগে আমার সমগ্র শরীর চিড়বিড় করে। আমি চুপ করে থাকি। ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে যায়। কফির মগ টা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দেই। নাজিয়া নিজে থেকেই বলে “ধর আমি যদি বলি আমি বেবি কনসিভ করছি, তুমি কি আমাকে ছেড়ে যাবা?
আমি- হ্যা যাবো, কারন যে বেবি আমার না তার উপর আমার কোন ইনফ্যাচুয়েশন নেই। তোমার সাথে শেষ কবে ইন্টিমেট হয়েছি মনে নেই। পিতৃত্বের দাবিদার লা মেরীডিয়ানের স্যুইট মেট তোমার বন্ধু বা অফিসের কেউ হবে। আমি না। লা মেরীডিয়ানের স্যুইট লেভেল মেইনটেইন করার মতো ইকোনমিক স্ট্যাবিলিটি আমার হয় নাই এখনো।
নাজিয়া- না জেনে ফালতু কথা বলবা না। এই জন্যই তোমার সাথে থাকা যায়না। অফিসের শায়লার সাথে সাজেক ট্যুর দিলে বুঝি চরিত্রের উন্নতি ঘটে।
আমি- শায়লার কাজিন রাসেল ছিল ট্যুরে, অফিসের আরো অনেকেই ছিলো, আর এক রুম বা স্যুইট শেয়ার করি নাই তোমার মতো। মেয়ে হয়ে যে ভাবে মদ, আর সিগারেট খাও আর অফিস মিটিংয়ের নামে যে স্যুইট এ যাও তাতে তোমার সাথে কোন ভদ্র পুরুষ থাকতে পারবে না।
নাজিয়া হড় বড় করে কি সব বলে যাচ্ছে। আমি আর মন দিয়ে শুনছি না। নিজের মাঝে অস্থির লাগছে। খুব সম্ভবত বিপি বাড়ছে। আমি ওয়েটার কে ডেকে বিল দেই, নাজিয়া বিল দেবার জন্য জোর করে। তাকে ছোট করার জন্যই ওয়েটার কে বলি- “হোয়াই ইউ ওয়ান্ট মানি ফ্রম এ মডেস্ট বেংগলী লেডী।” এই কথাতে নাজিয়ার আতে ঘা লাগে, তার চোখে আগুন খেলা করে। এই আগুন দেখতে আমার ভালো লাগে। সে চুপ করে থাকে। আমি কফি শেষ করায় মন দেই। খানিকটা বাদে সে একটা ব্যাগ আমাকে দেয়, বলে – তোমার দেয়া অর্নামেন্টস আছে এতে, আর কিছু ছোট খাটো প্রিসিয়াস গিফট, তোমার প্রিসিয়াস কিছু আমি আমার কাছে রাখতে চাইনা। অ্যাংগেজমেন্ট রিংটা রেখে দিতে চাই, স্মৃতি হিসেবে, পড়া হবে না তবুও একটা স্মৃতি হিসেবে থাকুক এটা আমার কাছে।”
আমি তাকে বলি”- উহু ওটাও দিয়ে দাও, আমার কোন কিছুতে তোমার স্পর্শ লাগুক বা তোমার আসে পাশের হাওয়া বাতাসে থাকুক এটা আমি চাইনা, ওটা দিয়ে দাও। “
আমার এই কথাতে সে মন থেকেই ব্যাথা পেয়েছে বলে মনে হয়। আমার মাঝে এটা দেখে সুখ সুখ অনুভুতি হয়, শেষ পর্যন্ত ওকে ব্যাথাতো দেয়া গেছে। সে আমাকে রিংটা ফিরিয়ে দেয়। আমি সেটা ওর দেয়া ব্যাগেই ভরে নেই। এরপর বলি -” তুমি তোমার মতো থাকো। তোমার আমার যেন আর কখনো দেখা না হোক।”
আর কিছু না বলে তাকেও কিছু না বলতে দিয়ে আমি বের হয়ে আসি। একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ি। খানিকটা সময় বাদে আমার কেমন যেন মনের মাঝে উথাল পাথাল লাগে। বুকে চাপ চাপ ব্যাথা অনুভূত হয়। মনের মাঝে কেমন একটা দুঃখ বোধ কাজ করে। একত্রে জগতের সকল দুঃখ রা আমাকে ঘিরে ধরতে থাকে। এই ব্যাথাবোধ, দুঃখকে থামিয়ে দিতে হবে। একে থামাতে হলে পান করতে হবে। আকুন্ঠ পান করলে এদের আটকে রাখা যায়। আমি রিকশা ছেড়ে দেই। দোকান থেকে চিপস, চানাচুর বাদাম, কোক নেই। দোকানে থাকা পাড়ার কাছে ছোট ভাই এটা দেখে, সে বলে”- ভাই বাসায় কি পার্টী আছে নাকি? আমাকে সাথে নেন ভাই। ভাবীর লগে তো ডিভোর্স হয়েই গেছে, বাসায় আপনি একা। একা একা এই সব তরল জমে নাকি। একা একা মজা শান্তি কিছুই পাবেন না। আমাকে সাথে নেন, আমি এক ছুটে গিয়ে কাশেমের দোকান থেকে কাবাব নিয়ে চলে আসি, কাবাবের খরচ আমার।” আমি তাকে সরাসরি রূঢ় ভাবে না বলে দেই। সে মনে কষ্ট পায়। আমি হাটা ধরি। হাটতে হাটতেই ভাবি একা একা কেন কষ্ট হবে? আমি হেটে চলি, আমার সাথে সাথে সাদা নরম আলো ছড়িয়ে স্থান পরিবর্তন করে চলে ছোট্ট এক টুকরো শুভ্র সাদা চাঁদ। তাকে দেখে আমার নিজেকে আর একা মনে হয়না, মনে হয় কেউ একজন পাশে পাশে চলছে আমার। সে আর আমি দুই ভুবনের দুই জন একা একা ডুবে যাবো আপন রাজ্যে।