বারবার এর বাংলা আভিধানিক অর্থ নাপিত। নরসুন্দর এর অর্থ যে নাপিত এটা আমি জেনেছি জীবনের বেশ কয়েকটা বসন্ত কাটাবার পরে। তারেক মাসুদ এর পলিটিকাল থ্রিলার ফিল্ম আছে নরসুন্দর নামে। নরসুন্দর কথাটা শুনতে ভালো লাগে, তাই তার এই ফিল্ম দেখতে গিয়ে আমি বুঝলাম আসলে এর অর্থ নাপিত। ক্ষৌরকর্মী ও বলা হয়ে থাকে তাদের কে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার নাপিত এর সবচেয়ে সুন্দর বাংলা মনে হয়েছে কেশবিন্যাস কারী। নাপিত নিয়ে এত প্যাচাল এর একটা সুনির্দিষ্ট মোজেজা আছে৷ সেই শানে নযুল খুব আনন্দদায়ক কিছু তেমনটা না। বরং আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন ভংগের একটা ছোট উপাখ্যান। তখন আমার সার্ভিস লাইফের প্রায় দুই বছর পার হয়ে গেছে। আশে পাশের পরিচিত ভাই বেরাদার, কাছের দুরের আত্মিয় স্বজন সকলেই ততদিনে লাইফে সেটেলড করে ফেলেছে। আমি একটা চিকেন কুপে বা মুরগির খাচায় আটকে গেছি। খাচা ভেংগে বের হবার উপায় খুজি তখন। চাকরি বাকরি করে যে জীবনে উন্নতি হবে না এই ধারনা মনের মাঝে গেড়ে বসা শুরু করেছে। সরকারি চাকরি হলে তাও একটা কথা ছিল। করি প্রাইভেট চাকরি। বংদেশে যারা প্রাইভেট চাকরি করে তাদের জীবনে হতাশা আর হতাশা। বংগদেশে প্রাইভেট চাকরিজীবি দের মনে একটাই সান্ত্বনা সেটা হলো “তারা মনে করে যে ভাবে কোম্পানি গুলা তাদের শ্রম ঘাম শুষে নেয় তাতে তারা বিনা হিসেবে জান্নাত পাবে।” আমার নিজের অবশ্য এই সান্ত্বনা তে মন ভরে না। আমার মনে হয় আমি বিদ্রোহ করি, গুড়িয়ে দেই, এই সমাজ, এই ফালতু সিস্টেম কে, কিন্ত দেহে জোর, মনে সাহস কোনটাই পাইনা। তাই বিদ্রোহ আর করা হয়না। সেবার সবার উন্নতি আর নিজের অবস্থা দেখে মনে মাঝে হতাশা জেকে বসা শুরু করেছে, ঠিক এমন সময়ই আমার অফিসে আমার সেইম পোস্ট এই নতুন একজন জয়েন করলো। তার বয়স আমার থেকে বছর দুয়েকের বেশি। আমার মতই অবিবাহিত। কাছাকাছি বয়েস বলেই খুব সখ্যতা হয়ে গেলো অল্প কয়েক দিনেই। ছেলেটার সবই ভালো, একটাই সমস্যা সেটা হল, সে চুড়ান্ত রকমের হতাশাগ্রস্ত। তার সাথে কেউ মিনিট পনেরো আলাপ সালাপ করলেই সে তার নিজের হতাশা অন্যের মাঝে অনায়েসে ঢুকিয়ে দিতে পারে। আমি যেহেতু তার মতই, তাই তার সাথে মিল হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে তার আমার মাঝে বেসিক পার্থক্য হলো, আমাই আমার নিজের হতাশা নিজের মাঝেই রাখি, আর সে ছড়িয়ে দেয়, তার মটো হলো, “আমি নিজে যখন শান্তিতে থাকবো না তুই কেন শান্তি তে থাকবি।” প্রবল হতাশা নিয়ে আমি আর সে অফিস করি। সিস্টেম এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চাই, প্রতিবাদী হতে চাই, কিন্ত দিন শেষে কিছুই করা হয়না। এই ভাবে কিছুদিন যাবার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যাবসা বানিজ্য কিছু একটা শুরু করবো, আশে পাশের মানুষ জন নিজে নিজে ব্যাবসা করে কত উপরে উঠে গেলো, আমরা কেন পারবো না। ফেসবুকে আম বেচে, কাপড় বেচে, মিষ্টি বেচে লোকে দাড়ায়ে গেলো আর আমরা কিছুই করতে পারলাম না। আমরা দুই জনে উঠে পরে লাগলাম, আমাদের সামান্য পুজি, সেই পুজিতে কি ধরনের ব্যাবসা করা যায় তার চিন্তা তে দিন রাত এক হয়ে যায়। আমার মাথায় ছোট খাটো কোন ব্যাবসার বুদ্ধিই আসেনা। আর তার মাথায় যে সব আসে সে সব করার জন্য যে ধরনের যোগ্যতা, ইফিসিয়েন্ট হওয়া দরকার তার কোনটাই আমাদের নেই। সে একবার বলল ” বিদেশী বিড়াল পেলে পুষে বড় করে বিক্রি করবে, হাই সোসাইটির ড্যাডিস গার্ল দের কাছে বিড়ালের ভালো চাহিদা আছে।” আমি তাকে এটা বুঝাতেই পারি না যে এই সব দেশী বিড়াল না যে মেঝেতে ভাত মাছ দিবেন আর খেয়ে বড় হয়ে যাবে, এই সব বিদেশী বিড়াল এর বায়নাক্কা অনেক। আর ড্যাডিস গার্ল খুজে বের করে সেল করাও বিরাট টাফ জব। যে আমার কথায় বেজার হয়। তার খুব ইচ্ছা প্রথম বিড়াল টা আমাদের এম ডি সাহেবের মেয়ের কাছে সেল করবে। আমি তো এই অফিসে পুরাতন আমি জানি এম ডি স্যার এর মেয়ে কি চিজ। আমি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কোন রকমে এই সব প্লান থেকে দূরে রাখি। আমার নিজের মাথাতেও তেমন কোন বুদ্ধি আসেনা। আর সে যত সব আজগুবি বিসনেস প্লান নিয়ে হাজির হয়। এই রকম আজগুবি প্লান আনতে আনতেই হঠাৎ সে একদিন একটা ভালো প্রোপোজাল দিয়ে ফেলল। ঠিক ভালো প্রোপোজাল বলা যায়না, এমন একটা প্লান দিয়েছে যেটা আমারো মনে ধরেছে। সে ঠিক করেছে, আমরা দুই জন মিলে একটা সেলুন দেবো। মোটামুটি আধুনিক সেলুন। নরসুন্দর রেখে দেবো। তারা চুল কাটাবে৷ দাড়ি কামাবে, ফেসিয়াল করে দেবে, কলপ করে দেবে, যেহেতু দোকান আমারা দেবো তাই পার কাস্টমার তারা আমাদের কমিশন দেবে। অফিস আওয়ারে আমরা ভিডিও মনিটরিং করবো, এর পরে সময় আমরা নিজেরাই ক্যাশে বসবো। ঢাকা এর মাঝে খুব নামীদামী জায়গায় দেয়া যাবে না। একটু নরমাল প্লেসে দিতে হবে। এই হচ্ছে প্লান। শুনে আমার মন্দ লাগেনা। যেহেতু আমার পছন্দ হয়েছে সেহেতু সেও রাজি হয়ে গেছে। আমরা একশনে নেমে গেলাম। ফিজিবিলিটি স্টাডিজ শুরু হলো। নেট ঘেটে বিভিন্ন ইনফেকশন কালেক্ট করি, সেলুনে ইউজ হয় এমন সব প্রোডাক্ট এর প্রাইস কালেক্ট করি, ট্রিমার, হট ওয়াটার, ভ্যাপ ব্লোয়ার এই সব মেশিন এর খুটি নাটি দেখি। এই সব দুই চার দিনের মাঝেই অনেকটা আয়ত্তে এসে গেলো। আমার সেই কলিগ তো তখনই সেলুন খুলে বসতে চায়। আমি তাকে বুঝাই এই ভাবে নেট দেখে হবে না, সেলুনে গিয়ে বিজনেস এর সালুক সন্ধান করতে হবে। নাট ঘাট না বুঝে দুম করে কোনো ডিসিশন নেয়া উচিৎ হবে না। সে নিম রাজি হয়। আমরা সেলুনে সেলুনে ঘোরা শুরু করলাম। কোন সেলুন ওয়ালাই ঠিক মত কথা বলতে চায়না। সেলুনের নরসুন্দর গুলোও মুখের ফাসা দিয়ে কিছু বের করেনা। তখন নতুন প্লান নিলাম, সেলুনে কাস্টমার হিসেবে যাব। দুই জন দুই সেলুনে যাব, এক সাথে গিয়ে লাভ নেই। শুরু হলো আমাদের সেলুন ভ্রমণ। রোজ রোজ তো চুল কাটানো যায়না। তাই দাড়ি শেভ করাই। আমি সপ্তাহে একবার শেভ করটাম এখন রোজ শেভ করি। রোজ সেলুনে শেভ করতে করতে মুখের স্কিনে পরিবর্তন হতে লাগলো। ব্যাবসায়িক হ্যাজার্ড হিসেবে নিলাম ব্যাপারটা। হ্যাজার্ড এর পরিনতি দিন দিন খারাপ হতে লাগলো। একটা অবস্থায় আমাকে স্কিন এর ডাক্তার এর কাছে যেতে হলো, তবুও আমি দমে গেলাম না। সেও দমে গেলো না।” কষ্ট না করিলে কেষ্ট মিলিবে না” এই মূলমন্ত্র নিয়ে আমরা কাজ করে যাই। অফিসের পরে চা কফির আড্ডা আমরা বাদ দিয়ে দিলাম। বিভিন্ন ধরনের চুলের কাটিং, দাড়ির কাটিং কালেক্ট করি, সেগুলো নিয়ে নিজেরাই আলোচনা করি। আমাদের আলাপে সব সময় এ থাকে চিরুনি, কাচি, ক্ষুর, সাথে আফটার শেভ, ফেসিয়াল এর প্রোডাক্ট। স্বপ্ন তখন আকাশ ছোয়া, আমরা ভাবি প্রথমে ঢাকা শহরে আমাদের আউটলেট বাড়াবো এর পর চিটাগাং, এর পর সব বিভাগীয় শহর, তারপর জেলা শহর, সারা বাংলাদেশ ছড়িয়ে দেব, তার পর সারা বিশ্ব। ব্যাবসাটা একটু দাঁড়িয়ে গেলেই, এম ডি স্যারের মুখের উপর রিসাইন লেটার ছুড়ে দিয়ে বলবো, এই চাকরির গোলামি করার জন্য আমরা জন্ম নেয়নি। কত শত স্বপ্ন যে আমাদের মাথায় খেলা করে, বুক জুড়ে চাপা একটা আত্মবিশ্বাস, সেও বিশ্বাস এর কারনে বুক ফুলে থাকে দু ইঞ্চি। ব্যাবসা শুরুর আগেই নিজের মাঝে মুকেশ আম্বানি ফিল কাজ করে। আমার কলিগো নিজেরে রতন টাটা ভাবে। এই মুকেশ আম্বানি আর রতন টাটার স্বপ্ন ভংগ হলো একই সাথে একই দিনে। সেদিনো দুই জন দুই সেলুনে গিয়েছি। আমি শেভ করাতে বসেছি, টুকটাক করে আলাপ জমাচ্ছি নরসুন্দর এর সাথে। আলাপ কিছুটা জমেও গেছে। মন দিল খোলা এক নরসুন্দর সে। যা জিজ্ঞেস করি রাখ ঢাক না রেখে জবাব দেয়। অনেক কিছু তার থেকে জানলাম। শেষ একটা প্রশ্ন করলাম তাকে, জিজ্ঞেস করলাম এই বিসনেস এর হ্যাজার্ড কি, হ্যাসেল কেমন? নরসুন্দর – মামা বাংলায় কন, ইংলিশ বুঝি না, আপনাগো মত তো বড় পাশ দেই নাই।
আম- মানে তোমার এই বিসিনেসে ঝামেলা কি, বিপদ আপদ কি আছে।
নরসুন্দর – বিপদ তো তেমন কিছু নাই। ঝামেলাও তেমন নাই, মাঝে মইধ্যে এলাকার নেতা ফেতা গো ফ্রিতে চুল দাড়ি কাইট্যা দেয়ন লাগে এই আর কি।
আমি- এটা তো তেমন কোন ঝামেলাই না। আর কোন বিপদ বা ঝামেলা কি আছে?
নরসুন্দর – না মামা আর কি ঝামেলা থাকবো?
সে মুখে আর কোন ঝামেলা এর কথা না বললেও আসল ঝামেলা আমি নিজেই প্রতক্ষ করলাম, কোন এক নরসুন্দর চুল দাড়ি কাটায় গন্ডগোল বাধিয়ে ফেলেছে। কাস্টমার তাকে সেটা ধরিয়ে দিলো। এবং তাকে তার ভুলের জন্য বকা ঝকা করলো। নরসুন্দর মে বি খেটে খাওয়া দরিদ্র শ্রেণির প্রতিবাদী যুবক সেও কম যায় না। সেও বেশ কড়া কথা বলল। কাস্টমার কে ভেবেছিলাম ভেবদা টাইপ, আদতে তার পুরো উল্টো, নরসুন্দর এর কড়া কথা শুনে সে লাফ দিয়ে উঠলো এবং উঠেই ধামা ধাম চড় থাপ্পড়। সেলুনের মালিক গ্যাঞ্জাম দেখে ছুটে আসলো, সে নরসুন্দর এর ছাফাই গাইতেই কাস্টমার ছুটে গিয়ে গদাম করে এক লাথি বসালো তার পেট বরাবরা। লাথি খেয়ে মালিক কোকাচ্ছে, প্রতিবাদী সেই নরসুন্দর ক্ষুর নিয়ে কাস্টমার কে মারার উদ্যত হতেই কাস্টমারের হাতে দেখলাম পিস্তল, সে বলল- “আই শুয়োরের বাচ্চা, তোরে একটা বিচি ভরে দেই, আমি ডিবির লোক, ক্রস ফায়ার বলে চালায়া দিমু।”
মালিক আর নরসুন্দর এর তেজ নেতিয়ে গেলো। আমি এক ফাকে বেড়িয়ে পড়লাম। এই রকম হ্যাজার্ড যে এই বিজিনেস এ আছে এমনটা আমার ভাবনাতেও ছিল না। চুল দাড়ি কাটতে গেলে এদিক সেদিক হতেই পারে। তাই বলে হঠাৎ করে এমন হবে তা কে জানতো। আমি মনে মনে ঠিক করলাম এই বিসিনেস করবো না। আমার কলিগ কে বুঝিয়ে বলাটাই কঠিন হবে। তবে আমার নিজের থেকে বলা লাগলো না। সে নিজেই জানালো এই ব্যাবসা সে করবে না, আমরা নতুন কোন আইডিয়া নিয়ে মাঠে নামবো। তার এই রুপ পরিবর্তন এর কারন যতই জানতে চাই সে না করে। পরে অনেক তোষামোদ করবার পরে সে আমাকে বলছে। আমি যেদিন অই ঘটনার শিকার হই সেও সেদিন আর এক সেলুনে গিয়ে আর এক প্রবলেমে পড়েছে। আমার মত তারো নরসুন্দর এর সাথে জমে গিয়েছিল। এমন জমাই জমেছে সে নরসুন্দর কে বলেছে সে নিজেই সেলুন দেবে সেই নরসুন্দর তার সাথে তার সেলুনে কাজ করবে কিনা?। সেলুন থেকে নরসুন্দর ভাগিয়ে নিয়ে যাবার প্রস্তাব কোনভাবে মালিক নিজেই শুনে ফেলেছে, এর পর ধুন্ধুমার কান্ড, নরসুন্দর কে তাও ইচ্ছামত গালাগালি করেছেই, আমার কলিগ কেও করেছে। বাবা মা তুলে গালাগালি আমার কলিগ সইতে পারেনি, সে প্রতিবাদ করতে গিয়ে চড় থাপ্পড় খেয়েছে, তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে সেলুন থেকে বের করে দিয়েছে। এই ঘটনার পর সে ঠিক করেছে ভিক্ষা করে খাবে তবুও কোনদিন সেলুনের ব্যবসা করবে না। আমাদের আম্বানি, রতন টাটা হবার স্বপ্নের এখানেই ইতি ঘটে। মনের দুঃখ মনে রেখে আমরা মুখ বুজে অফিস করি, কিছুদিন যাবার পরে আবার আমাদের মাঝে উদ্যোক্তা হবার বাসনা নতুন করে খেলা করে, আবার আমরা কিছু করবো বলে ঝাপিয়ে পরি, ঝাপ টাই শুধু দেয়া হয়, কাজের কাজ কিছুই হয়না। আমাদের উর্বর মস্তিষ্ক আমাদের তেমন কোন আহামরি কিছু করে ফেলার বুদ্ধি বের করতে পারেনা। আমরা রবার্ট ব্রুস এর মত লেগে থাকি। বয়স বাড়ে, চুলে একটা দুইটা পাক ও ধরে, আমাদের তবুও কিছু হয়না। আকাশের রঙ বদলে যায়, মেঘ হয়ে জল বৃষ্টি হয়, রংধনু উঠে, আবার মিলিয়ে যায়। আমাদের কিছুই হয়না। সকল দীনতা মেনে নিয়ে, চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে আমরা জীবন টেনে নেই, আর ভাবি সামনের দিন গুলো শুধুই আমাদের।