প্রায় এক ঘন্টা ধরে আমি ওয়েট করছি। কারওয়ান বাজার ওয়েট করার জন্য আদর্শ স্থান না। আদর্শ স্থান পেট্রোবাংলা বিল্ডিং এর অপোজিট এর প্যান প্যাসিফিক সোনারগা। যার জন্য ওয়েট করে আছি তার সাথে আমার অবশ্য সাক্ষাত হবে সোনারগা হোটেলে৷ আমি খেটে খাওয়া মানুষ। সরাসরি তাই সোনারগা হোটেল এ বসে অপেক্ষা করবো এই সাহস কুলাচ্ছে না। অফিসের গাড়ি আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে বেশ আগেই। এখন আড়াইটা বাজে। উনার আসার কথা শার্প দেড়টাই। একসাথে লাঞ্চ এবং মিটিং হবার কথা। উনি বেশ বড় কোম্পানির জি এম। আর আমি একটা মোটামুটি কোম্পানির সার্ভিসের লোক। তার মত মানুষের সাথে আমার ফাইভ স্টারে বসে মিটিং করবার কথা না। আমি করতেও চাই না। নিউ প্রডাক্ট ক্যাম্পেইন অথবা কোম্পানির অ্যানুয়াল ফাংশন অথবা কোন বড় ট্রেনিং অ্যারাঞ্জ হলে শুধু পাচ তারকা হোটেলে যাওয়া হয়। এবং যতবারই গিয়েছি আমি ইনফিরিওরেটি কমপ্লেক্সে ভুগেছি। পাচ তারকা হোটেলের এর বিভিন্ন এটিকেট আছে। আমার মনে ভয় কাজ করে এই বুঝি কোন উল্টা পাল্টা করে ফেললাম। আজকে যার সাথে দেখা করতে এসেছি তিনি আমাদের নিউ ক্লায়েন্ট৷ তাদের কে যে প্রোডাক্ট দেয়া হয়েছে তার মাঝে অল্প কিছু ড্যামেজ বের হয়েছে। সাধারণত পাচ পারসেন্ট এর কম ড্যামেজ হলে আমরা আফটার সেলস সার্ভিস দেইনা৷ কিন্ত এখানে ব্যাপার আলাদা উনারা নিউ একটা প্রোডাকশন লাইন খুলতে যাচ্ছেন, সেখানে আমাদের মেশিনারিজ টুলস এ গুলার ভাল একটা বাজার আছে তাই পলিসির বাইরে গিয়েও তাকে আমরা আফটার সেলস সার্ভিস দিয়ে খুশি রাখার ট্রাই করছি। এই সব মিটিং হ্যান্ডেল করে সেলস এর মোসতাক ভাই। আমি কোনদিন এই ধরনের মিটিং ফেস করি নায়। মোসতাক ভাই এর সাথে আমার বেশ ভাল সর্ম্পক আছে আলাদা ডিপার্টমেন্ট হলেও। এই সর্ম্পকই কাল হয়ে দাড়ালো। উনি হঠাৎ করেই সিক হয়ে গেলেন। এদিকে ক্লায়েন্ট কে ডেট দেয়া হয়ে গেছে। সেলস এর সিনিয়র এবং মিড লেভেলের সকলেই বিজি। এদিকে মিটিং ক্যান্সেল করা যাবেনা। ভাল সর্ম্পক কাল শাপ হয়ে দংশন করল। মোসতাক ভাই আমার নাম রিকমেন্ড করলেন। আমি গাই গুই করছি দেখে ম্যানেজার আমাকে বললেন- “কি ব্যাপার আপনি সিনিয়র হয়ে এত নার্ভাস কেন। সামান্য একটা ব্যাপার, যাবেন, টুকটাক আলাপ করবেন, লাঞ্চ করে ফিরে আসবেন এতে না করার কি আছে।”
অগ্যতা বিরস বদনে বের হতে হল। আমি ঠিক সময়েই এসেছি৷ এসে তাকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন তার একটু লেট হবে। আমি যেন ভেতরে তার জন্য ওয়েট করি। ভেতরে যাবার সাহস হল না। পাচ তারকা হোটেলের এটিকেট এর মারপ্যাচ আমি নিলাম না। লাঞ্চ ভেতরে করবার কথা সেটাও করা যাবেনা। আমি লেবু কচলায়া ভাত ডাল মেখে খাওয়া মানুষ। আমি তাই কারোওয়ান বাজারের একটা হোটেলে ঢুকে খেয়ে নিলাম। পাচ তারকা হোটেলের ফর্ক, স্পুন, নাইফে আমি ইউজড টু না বলেই বাইরে খাওয়া। সেখান থেকে বের হয়ে আমি হোটেলের গেটের কাছে ওয়েট করছি। ওয়েট করতে খারাপ লাগছে না। প্রচুর ব্যস্ত মানুষ আসা যাওয়া করছে। তাদের ব্যস্ততা দেখতে ভাল লাগছে। সমস্যা একটাই গাড়ির হর্ণ। আমি উচ্চমাত্রার শব্দ নিতে পারি না। তবে বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলোনা। তিনি ফোন দিলেন। তিনি এরই মাঝে এন্ট্রি করে গেছেন। আমি কেন এখনো যাই নাই এটা নিয়ে একটু রাগ দেখালেন। আমি ঢুকে পড়লাম। গিয়ে দেখি উনি কোনার দিকের একটা টেবিলে বসে আছেন। তার বসার মাঝেই ব্যস্ততার ভাব। মুখ দেখে মনে হল সকালে ভাল করে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়নি তাই কেমন যেন শরীরের মাঝে একটা অশান্তি অশান্তি ভাব। আমি সালাম দিলাম। সালামের জবাব না দিয়ে হাতের ইশারায় আমাকে বসতে বললেন। আমি বসলাম। কথা শুরু করব তার আগে একজন এলো। মে বি তার ড্রাইভার। তার থেকে চাবিটা নিয়ে তাকে বাইরে খেয়ে নিতে বললেন। এবং বললেন ঠিক ছয়টায় যেন সে তাকে ফোন দেয়। আমি বুঝলাম না এর মানে। ড্রাইভার তো খেয়ে এসে পার্কিং এই ওয়েট করতে পারে। ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করব সেই সুযোগ তিনি দিলেন না। উনি বললেন – তো লাঞ্চ এর ওর্ডার দেই। আপনি কি খাবেন?
আমি- যে কোন কিছু। লাইট কিছু হলে ভাল হয়।
উনি- বোকার মত কথা বলবেন না। আপনি সন্ধ্যা বেলার ডেটিং এ আসেন নি। ইটস লাঞ্চ টাইম। মোস্ট ওফ দা বাংগালি টেকস হেভী মিল ইন লাঞ্চ।
আমি কিছু না বলে মাথা নেড়ে তার কথার সায় দিলাম, যে, আমি বোকা। উনি ওয়েটার কে ডেকে কি সব ওর্ডার দিলেন তার মাঝে একটা শব্দই আমার পরিচিত ছিল তা হল একটা ক্যাপাচিনো কফি যেটা আফটার লাঞ্চ সার্ভ করবে। এই বেটা যেটারই ওর্ডার দিক বিল তো আমাকেই দিতে হবে। ভুল হল আমাদের কোম্পানি পে করবে। তার সাথে ডাইরেক্ট কথা শুরু হল এবার।
উনি- আমি আপনাদের সার্ভিস এ স্যাটিস্ফাইড না। অল্প কিছু প্রোডাক্ট তার মাঝেই এতগুলো ফল্টি প্রোডাক্ট কেন হবে।
আমি- স্যার ফল্টি প্রোডাক্ট পাচ পারসেন্ট হতে পারে এটা আমাদের সিস্টেম এই আছে।
উনি- ফাক ইউর বুলশিট সিস্টেম। নাও টুয়েন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরি এখানে ফল্ট এর কোন স্পেস নায়।
আমি- স্যার আমরা আফটার সেলস সার্ভিস করে দেব।
উনি- ইউ মাস্ট ডু দ্যাট। আদার ওয়াইজ আমি আপনাদের অফিসের সামনে ঘুঘু চড়াবো।
আমি-স্যার এতটা অফেন্সিভ হবেন না। তাছাড়া ঘুঘু স্যার বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গেছে।
উনি- ডোন্ট মেক থার্ড ক্লাস জোকস উইথ মি।
আমি – সরি স্যার। মিসটেক হয়ে গেছে। স্যার এই চালান এর গুলো আমরা ফুল সার্ভিস করে দেব। যদি আমাদের সাথে আপনারা নেক্সট ডিলিং এ যান তাহলে এটা পুরোপুরি রিপ্লেস করে দেয়া যেতে পারে।
উনি- নেক্সট ডিলিং এর নেগোসিয়েশন আপনার সাথে করবো না। মোশতাক না কে আসে যেন আপনাদের সেলস এ ওর সাথে কথা বলব। বাই দা ওয়ে আপনি ওকে বলবেন শুধু মুখের কথায় এত বড় ডিল হয়না। কিছু এক্সট্রা কনভিনিয়েন্স যেন সে প্রোভাইড করে৷
আমি- সরি স্যার, এক্সট্রা কনভিনিয়েন্স টা কি?
উনি- আপনি সেলসে আছেন কত দিন?
আমি- স্যার আমি সেলস এর না, সার্ভিসের।
উনি- হোয়াই ইউর কোম্পানি সেন্ড ইউর টাইপ অফ ইডিয়ট ফর মিটিং।
আমি উনার কথার জবাব দিতে পারলাম না। প্রাইভেট জব করলে এই সব ছোট খাটো হিউমিলিয়েশন মেনে নিতে হয়। আমি চুপ করে আছি দেখে উনি আবার বললেন- টেল মোশতাক টু টক উইথ মি। হেভ ইউর লাঞ্চ।
উনি যা শুনালেন তাতে লাঞ্চ করাটা ডিফিকাল্ট। আর ফর্ক স্পুন এর লাঞ্চ আমার পুশাবে না। উনি দেখলাম বেশ আয়েশ করে খাচ্ছেন। সাথে ফোন স্ক্রল করছেন। আমি বিল পেমেন্ট না করে উঠতেও পারবনা। আমি কিছু খাচ্ছিনা এবং উশখুশ করছি দেখে উনি আবার বললেন-এনি প্রবলেম? হোয়াই ডোন্ট ইউ টেক মিল। দা ফুড আর রিয়েলি টেস্টি৷
আমি- খিদে নেই স্যার।
উনি- দেন পে এন্ড ইউ মে গো। আপনার সাথে আমার মিটিং শেষ। আর আমার উঠতেও সময় লাগবে। লাঞ্চ শেষ করে আমি এখানে সন্ধা পর্যন্ত স্টে করবো। এদের এখানে পুলে আমি সুইমিং করি মাঝে মাঝে। আজকে করে দেন যাব। ইফ ইউ হ্যাভ এনাদার টাস্ক ইউ ক্যান গো।
আমি যাবার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। ওয়েটার কে কল করে কার্ড দিলাম বিল পে এর জন্য। সে রিসিট কপি আনতে গেছে। এমন সময় স্যার এর ফোন এল। ওপাশের কথা আমি শুনতে পাচ্ছিনা৷ তবে স্যার কে বেশ উত্তেজিত লাগছে। উনি বলছেন- “না না, এত লেট করবে কেন। সালাম ভাই এর সাথে অনেক দিনের সর্ম্পক উনি থাকতে মাল পাঠাতে কোনদিন লেট হয়নায়। সেটা যে হোটেলেই হোক। আর আপনি অলোয়েজ ইলেভেনথ আওয়ারে বলেন লেট হবে। আর গতবার যারে পাঠায়ছেন তার সার্ভিস ও ভাল ছিলনা। নিও কামার পাঠালে একটু ট্রেইনড করে পাঠাবেন। “
আবার বলছেন এক ঘন্টা লাগবে। এত সময় নাই। গাড়ি পাঠাতে হবে কেন। মেয়েটা এখন কোথায়?”
মেয়ে শব্দটা শুনেই আমার বোঝা হয়ে গেল স্যার এর আলু পটলের দোষ আছে। এর নাম সুইমিং। মিউচুয়াল সুইমিং হবে তবে সেটা পুলে না বেডে। উনি তখনো কথা বলে চলেছেন।
“নো নো, আই কান্ট সেন্ট মাই কার। আজকে আমার ড্রাইভার নায়। আমি উবারে এসেছি।”
আমাকে কার্ড আর রিসিট দিয়ে গেল ওয়েটার। আমি যে এতক্ষন খুব মন দিয়ে স্যার এর কথা শুনেছি এটা উনি ভাবেন নাই। আমি তাই উঠি বলে চেয়ার থেকে উঠলাম। উঠে তাকে বললাম- “স্যার গাড়ির প্রবলেম থাকলে আমি আমাদের অফিসে বলে আপনার জন্য এখন একটা গাড়ি ম্যানাজ করে দেই। “
উনি আমার দিকে চোখ গরম করে যেভাবে তাকালেন তাতে যে কারো ভয় পাবার কথা। আমি ভয় মনের মাঝে রেখে বললাম- ” গাড়ি কি লাগবে স্যার?”
উনি- গেট লস্ট।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। হাটা দিলাম। স্যারের জন্য খারাপ লাগসে একটা গাড়ির জন্য স্যারের আনন্দবিলাস থেমে আছে। আজকাল সবাই কেমন যেন হয়ে গেছে। ক্লায়েন্ট সাপোর্ট কেউ ঠিকঠাক দিচ্ছে না।