Blog

সদ্য সদ্য বংগদেশের লক ডাউন নামক মজার খেলার বিরতি চালু হয়েছে সপ্তাহ খানেকের জন্য। ত্যাগের মহিমায় উদ্ববেলিত হবার জন্য আমাদের এখন কুরবানির প্রিপারেশন নিতে হবে। গরু ছাগল কিনে ফেলতে হবে, গরুর পাছায় থাবড়া দিয়ে ল্যাজ ধরে টেনে টুনে তাকে ঘর অব্দি না নিয়ে আসা পর্যন্ত শান্তি নেই। পশু ক্রয়ের ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা খুব উচুদরের না। স্কুল লাইফে একবার আর কলেজ লাইফে একবার হাটে গিয়েছিলাম। আর এছাড়া নিজে একবার খাচা সমেত এক জোড়া খরগোশ কিনেছিলাম। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে গর্ব করা যায় না। আর অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি হাটে আসা শতকরা আশি ভাগ গরুরই মেজাজ চড়া থাকে, এরা ঢুস দেবার তাল খোজে সব সময়। একটু সুযোগ পেলেই পা মাড়িয়ে দেয়। পিছনে থাবড়া দিয়ে মাংস বুঝতে গেলে হঠাৎ করেই বারী বর্ষণ করে জামা কাপড় ভিজিয়ে কটু গন্ধময় করে দেয়। এই ধরনের হেপা হয় বলেই প্রতিবারই কুরবানির হাটের প্রোগ্রাম আমি কোন না কোন ওছিলায় কাটিয়ে দেই। এবার কেন যেন পারলাম না। জেষ্ঠ ভ্রাতা কি কাজে যেন ব্যস্ত হয়ে গেল। সে বড় কাজের লোক আমার মত চায়ের দোকানে বসে শাবানা জসীমের সিনেমা দেখা পাবলিক না। এর পরেও আমি না করেছিলাম। আব্বার উপর দ্বায়িত্ব দিয়ে দিয়েদিলাম। আব্বাও নিমরাজি। বাধ সাধলো মমতাময়ী মাতা। তিনি অনুযোগ করলেন আমার হৃদয় নাকি সীমারের চেয়েও কঠিন। কঠিন না হলে এই করোনা মহামারীর মাঝে নিজে না গিয়ে বয়স্ক বাবা কে হাটে যেতে বলি। মা কে জবাব দেয়া যেত, আমার যাওয়াটা সেফ না। আমার করোনার ভ্যাক্সিন দেয়া নায়। আব্বার আছে। আমি মা কে সম্মান প্রদর্শন স্বরুপ কিছু বললাম না। আমাদের ভাগে কুরবানী৷ পাশের বাসার রহমত আংকেল এর চার ভাগ আমাদের তিন ভাগ। রহমত আংকেল এর ছেলে সাবিত ভাই আর আমি হাটে যাব। যদি গরু না পাই তাহলে নধর দেখে দুটো দুটো চারটে খাশি কিনবো। ডেট ফাইনাল। সাবিত ভাই এর কাজ আছে। উনি সরাসরি হাটে যাবেন। আমি যাব বাসা থেকে। হাটে মিট হবে। আমি আল্লাহ এর নাম নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। ঠাঠানো রোদ পড়েছে। চোখে রোদ চশমা পড়ে, পায়ের উপর পা দিয়ে লাট সাহেবের মত রিকশায় বসেছি। ভাব খানা এমন যে বি এম ডাব্লিউ তে বসে আছি। খানিক দূর যাবার পড়ে, এক মুরুব্বি টাইপ চাচা হাত নাড়লো রিকশা থামাবার জন্য। রাস্তায় রিকশা কম। হাটের রাস্তায় ভীড় তাই তেমন কোন রিকশা এই দিকে আসছে না। আমি বলিনি রিকশা থামাতে, তবুও রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়েছে। আমার পায়ের উপর পা তুলে ভাব ধরে বসা আর হল না। মুরুব্বি চাচা – “বাবা কি হাটে যাবা?”

মনে হল বলি ”মংগল গ্রহে যাব।” নিতান্তই সিনিয়র সিটিজেন বলে বলা হল না। বললাম -” হ্যা,।”

চাচা-আমাকে একটু নামিয়ে দাও। অনেকখন দাঁড়িয়ে আছি। রিকশা পাচ্ছিনা। আমার ছেলে অফিস শেষ করে পৌছে গেছে। আমার একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। দরকার হলে আমি ভাড়া দেব।

আমি উনাকে রিকশাতে নিয়ে নিলাম। কেউ ভাববেন না ভাড়ার টাকার জন্য নিলাম। মুরুব্বি মানুষ কে উপকার করে সওয়াব হাসিলের জন্য নিলাম। শুধু দুনিয়াবি চিন্তা করলে তো হবে না। আখিরাতের চিন্তাও করতে হবে। তাই যখন যেভাবে পারা যায়, সওয়াব কামায়ে নিতে হবে। তখনো জানতাম না এই সওয়াব কাল শাপ হয়ে দংশন করবে। রিকশায় পাশাপাশি বসে আছি। এক সাথে এক গন্তব্য যাব, টুকটাক আলাপ হচ্ছে। উনি পেশায় ছিলেন শিক্ষক। শিক্ষক হবার দরুন সবাই কে ছাত্র ঠাওরানোর অভ্যাস তার যায়নি। আমাকে নানাবিধ উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমি বিরক্ত হয়ে হু হা বলে তাল দিচ্ছি। তিনি বললেন- “গরু চেনার উপায় আছে, তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি পড়াশোনাতে তেমন ভাল না, গরু ছাগল কেনবার বুদ্ধি শুদ্ধিও তোমার কম। “

আমি চুপ করে থাকলাম, বুদ্ধি শুদ্ধি আমার কম এটা মানলাম, কিন্ত আজ যদি ধৈর্য কম হত তাহলে বুড়া মিয়ারে রিকশা থেকে ধাক্কা দিয়ে নামায়ে দিতাম। তিনি দুনিয়ার কথার সমুদ্র পেড়ে ফেললেন। সে সব কথার সারমর্ম হল, আমার বুদ্ধি কম, লেখাপড়া কম, অভিজ্ঞতা কম, শেখার আগ্রহ কম। দশ মিনিটের পরিচয়ে আমাকে উনি মেপে ফেলেছেন। ভাগ্য ভাল হাটে এসে পড়লাম। নেমেই ভাড়া দিয়ে দ্রুত হাটে ঢুকে গিয়েছি। এই খিটকেল বুড়া জান পানি করে দেবে একসাথে থাকলে। আমি আর সাবিত ভাই ঘুরে ঘুরে গরু দেখছি। দামে পুষালে গরুর সাইজ ভাল হয়না। সাইজ পছন্দ হলে দামে পুশে না। ঘন্টা খানেক ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। আমি আর সাবিত ভাই রেস্ট এর জন্য হাট থেকে বের হয়ে একটা টংয়ে ঢুকেছি। সাবিত ভাই সিগারেট আনতে গেছে। ও মা। সেই বুড়াও দেখি এসে বসেছে। তারও রেস্ট এর জায়গা এটা। আমি মাথা ঘুরিয়ে বসলাম যাতে আমাকে না দেখে। কাজ হল না। বুড়া উঠে এসে আমার পাশেই বসলো। বসেই শুরু হল প্যাচাল। এই বার বুড়া আমাকে সরাসরি আক্রমন করা শুরু করল। কোথাই পড়াশোনা করেছি। কোন স্কুল, কোন কলেজ, এখন কি করি। আমি তার সব প্রশ্নের কাটা কাটা জবাব দিচ্ছি। উনি বুঝেতেই পারছেন না আমি তার উপরে বিরক্ত। সাবিত ভাই এর একটা পানির বোতল আমার কাছে ছিল। আমি মুখখা খুলে পানি খেলাম দুই ঢোক।

চাচা- বোতলে কি স্যালাইন?

আমি- না শুধু পানি।

চাচা- যে গরম পড়েছে, এই গরমে স্যালাইন খেতে হয়, বুদ্ধি শুদ্ধি কবে হবে তোমার।

আমি- চাচা পানি খেয়েই আমার কাজ হচ্ছে।

চাচা- কাজ হচ্ছেনা বলেই তো ইয়াং এজের একটা ছেলে পাচ মিনিট হাট ঘুরে কেলায়ে বসে পনেরো মিনিট রেস্ট করছো। তুমি স্যালাইন বানাতে জানো তো, নাকি এটাও জানো না।

আমি- জি জানি, আর এখন পাচ টাকায় এমনি স্যালাইন পাওয়া যায়, বানানোর দরকার কি।

চাচা- রেডিমেড কি আর অত ভালো হয়। আসল স্যালাইন হয় গুড় দিয়ে লবন দিয়ে।…..

আমি ওনার কথা আর শুনলাম না, সাবিত ভাই চলে এসেছে, চাচা কে কিছু না বলে টং থেকে বের হয়ে গেলাম। ভাবলাম আপদ কাটানো গেল, কিন্তু আপদ পুরোপুরি কাটলো না। আমরা হাট ঘুরে ফিরে তেমন কোন কিছুই গেইন করতে পারলাম না, অগ্যতা দুইজন হৃষ্ট পুষ্ট, নধর, তাগড়া দেখে এক হালি খাশি কিনে ফেললাম। দুই হাতে দুই দড়ি ধরে দুই ছাগল টানতে টানতে নিয়ে আসছি। হাটের মূল ফটক পার হলাম। খাশি গুলা শরীরের দিক দয়ে যেমন বড়, শক্তি ও আছে ভাল। টেনে নিয়ে যেতে পরিশ্রম হচ্ছে। আর এরা ভ্যা ভ্যা ম্যা ম্যা করে তার স্বরে ডাক পারছেই। কুরবানির পশু তাই গায়ে হাত তুলতে পারছি না। হাটের ফটক পেড়িয়ে একটু সামনে এগিয়েছি, দেখি চাচা মিয়া। ছেলের সাথে গজ গজ করছে। ছেলে নাকি পিছন থেকে গরু কন্ট্রোল করতে পারছে না। তাই এবার ছেলে সামনের দিকে ধরবে আর উনি পিছনে ট্যাকল করবেন। আমাদের দেখেই তিনি বললেন- ”আগেই বুঝেছিলাম তোমাদের দিয়ে গরু কেনা হবে না, এই যুগের লুতু পুতু পোলাপান দিয়ে কি আর হাটের গরু কেনা যায় নাকি?” আমি ওনার কথার জবাব দিলাম না। সাবিত ভাই বলল- ” এই লোকটা কে, চিনো নাকি আগে থেকে?

আমি- উনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আগে শিক্ষক ছিলেন, এখন রিটায়ার্ড করে আমাদের মত পোলাপান পাইলে জ্ঞান এর জাহাজ খুলে বসেন।

সাবিত ভাই- আমরা একটু দাড়াই, উনি আগে যান। পাশাপাশি যাবার দরকার নেই।

আমরা একটু দাড়ালাম, এরপর চলা শুরু করলাম। তাদের সাথে দূরত্ব বেশি না। উনাদের দেখা যাচ্ছে। তবে উনাদের আর খেয়াল করছি না। একটু দূর যেতেই চিতকার শুনে সামনে তাকিয়ে অবাক হলাম, চাচা মিয়া মাটিতে পরে হাটু ধরে গড়াগড়ি দিচ্ছে। সম্ভবত গরুর লাথি খেয়েছেন। বয়স্ক একটা মানুষ গরুর লাথি খেয়ে চেগায়ে পড়েছেন এটা একটা হৃদয় বিদারক দৃশ্য তবুও মনে কেন যেন দুঃখ আসছে না । বরং অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখছি। কেউ যে এগিয়ে এসে তাকে তুলবেন তেমনটা হচ্ছে না। সবাই নিজ নিজ গরু নিয়ে ব্যস্ত। তার ছেলেও গরুর দড়ি ছেড়ে এসে তাকে ধরতে পারছে না। বাবাকে ধরতে গিয়ে গরু যদি পালয়ে যায় এই ভয় তার মনে। সাবিত ভাই আমাকে বললেন- “তোমার খাশি দুটা আমাকে দাও। গিয়ে চাচা মিয়া কে উঠাও।” আমি অনিচ্ছা সত্তেও এগুলাম। বেশিদূর যেতে হল না। গরু এবার পিশাপ করা শুরু করল, চাচা হাটুর ব্যাথায় নড়তে পারছে না। ছেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছে, গরু হলুদ বারী বর্ষন করেই যাচ্ছে, হলুদ বারিতে চাচার পাঞ্জাবি ভিজে চপচপা হয়ে গেল চোখের সামনে। আমি পিছিয়ে এলাম।

সাবিত ভাই- কি হল উনাকে না ধরেই ফিরে আসলা কেন?

আমি- ভাই পিসাপ সেটা মানুষের হোক অথবা গরু ছাগলের হোক সেটা অপবিত্র। গরুর চেনার নির্যাস গায়ে লাগিয়ে আমি অপবিত্র হতে পারবো না। আমার কাছে পবিত্রতা সবার আগে। ধর্ম বইয়ে পড়েন নাই নাকি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অংগ। আমি বুড়ার উপকার করতে গিয়ে ঈমান নষ্ট করতে পারবো না।

সাবিত ভাই কিছু বললেন না। দুটো খাসির দড়ি আমার হাতে দিয়ে দিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *