শুক্রবার ছুটির দিনের সন্ধ্যেবেলাটা পার হয়ে গেলে মনটা কেন যেন খুব খারাপ হয়ে যায়, বড় একা একা লাগে, বুকে হালকা চাপ চাপ ব্যাথা হয়। মাথার মাঝে অযথায় অযাচিত চিন্তা খেলা করে। সেসব ভুলে থাকার জন্য মাঝে মাঝে আনিস এর চা কাম চটপটির দোকানে গিয়ে বসে থাকি। আনিস এর দোকানের বিশেষত্ব হলো তার দোকান পুকুরের উপরে ভাসমান। সেই পুকুরের জল কাকচক্ষু এর মতো পরিষ্কার এবং নদীর জলের মতোই টলটলে। বাশের মাচায় বসে সেই জলে পা ডুবিয়ে বসলে খানিকটা শান্তি বোধ হয়। আমি স্যান্ডেল সমেত পা ভিজিয়ে বসে আছি। আমার থেকে খানিক দূরে একটা মেয়ে বেশ একটু ঝুকে বসেছে, সে শুধু স্যান্ডেলই নয় পাজামা অব্দি ভিজিয়ে রেখেছে। সন্ধ্যার পরের আধার দেখেই তার চেহারা দেখতে পারছি না ভালো করে, তবে মার্জিত পোশাক দেখে মনে হয়েছে সে দেখতে ভালো। তার দীঘল লম্বা চুল বাশের মাচা ছুয়ে রয়েছে। খুব ইচ্ছে করছে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে এক সাথে পাশে বসে গল্প করতে। অবাস্তব সব চিন্তা চলে আসছে। অচেনা অজানা কোনো মেয়ের পাশে বসে হুট করে গল্পে মেতে ওঠা যায়না, চুল ধরা তো আরও পরের আলাপ। মেয়েটা আরো কিছুটা সময় বসে রইলো এরপর ভিজা পাজামা নিয়েই উঠে হাটা ধরল। এবার তাকে আমি দেখলাম, তার চোখ জুড়ে গাঢ় কাজল দেয়া, মুখে বিষন্নতার তীব্র ছাপ, আমি বিষন্নতা সবচেয়ে অপছন্দ করি। কাজল চোখের সেই মেয়ের চেহারা জুড়ে মায়া আছে। কাজল দিলে আপনা থেকেই মেয়েদের চোখের মাঝে মায়া মায়া ভাবটা চলে আসে। আমি অনেকটা সময় তাকে মন দিয়ে লক্ষ করছি এই ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেই যাবার আগে আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য একটু মৃদু হাসি দিলো। সেই হাসিতেই আমার মন খানিকটা ভালো হলো। মানুষ খুব আজব শ্রেনীর এক প্রাণী, অতি অল্পতেই তার মন খারাপ হয় অতি অল্পতেই তার মন ভালো হয়ে যায়। মেয়েটা চলে গেলে আনিস আমাকে এক কাপ স্পেশাল চা দিয়ে গেলো। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি, জলে পা ভিজিয়ে পা নাচাচ্ছি মন ভালোর দিকে যাচ্ছে। কালকে থেকে অফিস আছে এটা মাথা থেকে দূর করতে হবে। চাকরি মানেই গোলামি, গোলামির মাঝে কোন আনন্দ নেই। আমার পাশে কে যেন এসে বসল, আমি ভালো করে লক্ষ করতেই দেখলাম তিনি আমার চেনা জানা লোক। তার নাম হোসেন আলী। ডাক নাম নেই, চেনা পরিচিত সকলে অবশ্য হতাশ হোসেন বলে ডাকে। আমি তা ডাকি না, কারণ এই লোক সর্বদা হতাশার গল্প বললেও মাঝে মাঝে দামী কিছু কথা বলে ফেলে জেনে বুঝেই হোক অথবা না বুঝেই হোক। হোসেন আলী এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো- কি খবর, মন টন ভালো তো? আমি-“মন ভালো না।” হোসেন-” কেন?” আমি-” শুক্রবার টা ফুরুত করে চড়ুই পাখির মতো উড়াল দেয় কেন বলতে পারেন? ছুটির একটা দিন চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই শেষ।” হোসেন-” হা হা হা, তুমি আছো শুক্রবার নিয়ে, এক যুগ দুই যুগের ভালোবাসাই স্থায়ী হয়না, ফুরুত করে ভালোবাসা উধাও হয়ে যায়, মানুষ একা হয়ে যায় আর তুমি চিন্তা করছো শুক্রবার টা টিকে যাবে, বোকার মতো কথা না এটা, এটা হল বোকা** মতো কথা। দিন দিন দেশে চার অক্ষরের বোকা বাড়ছে এটাই আফসোস।” তার কথাতে আমি রাগ করি না, একটু হেসে আমি বলি-” সপ্তাহে তিনটে শুক্রবার হলে বেশ হতো তাই না ভাই? হোসেন-” তোমার জন্য সাত দিনই শুক্রবার, কিন্তু অফিস করবা সাত দিনই, হা হা হা। আমি পা জল থেকে তুলে নিয়ে উঠে পড়ি। ভালো লাগছে না। চায়ের বিল দিয়ে চলে এলাম। রাস্তায় হাটছি মাথায় ঘুরছে তিনটে দিন শুক্রবার হলে ক্ষতি কি? কতো মানুষের তিন বউ থাকে, পাচটা সাতটা গার্লফ্রেন্ড থাকে, তাদের জন্য তো ভালোবাসার কমতি নেই। কেউ একজন হারিয়ে গেলে তারা আরো বেশি ভালোবাসার জন্য সাথে সাথে আরো দুটো মেয়েছেলে কে জীবনে জড়িয়ে নেয়। এই ভাবে যদি জীবনে মেয়েছেলের ভালোবাসা বাড়িয়ে নেয়া যায় তাহলে সপ্তাহে তিনটে শুক্রবার নিয়ে আসা যায়না কেন? জীবনে আরাম আয়েশ ছুটি এগুলোই আসল সত্য বাকি সকল সত্যই মিথ্যা। পাপ পূন্যের সকল হিসেব তো পরের জীবনে হবেই, জাগতিক জীবনটা না হয় একটু আয়েশেই ভরে উঠুক। শুক্রবার ফিরে ফিরে আসুক সকলের জীবনে।
হঠাৎ কোন একদিন ভোরবেলা আকাশ ভেঙে তীব্র বৃষ্টি নামবে, উঠবো না উঠবোনা করে ঘুম থেকে জেগে উঠবো। জানালার পর্দা সরিয়ে , কাচ তুলে দিয়ে সেই সেই শুভ্র সতেজ ঝুম বৃষ্টি দেখবো। চারপাশ জুড়ে অবিরত গড়িয়ে পড়া সাদা বৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই নেই। চোখ সরিয়ে ইশান কোনে নিতেই তোমাকে দেখতে পেলাম, শ্বেত শুভ্র এক স্যালোয়ার পড়ে দু হাত মেলে ছাদে হাটতে হাটতে তুমি বৃষ্টিতে ভিজছো। দূরের জানালা থেকে তোমাকে লক্ষ্য করে চলা এই আমি ভাবছি কে বেশি শুভ্র সাদা, বৃষ্টির জল নাকি সাদা স্যালোয়ার পড়ে থাকা তুমি? এর উত্তর কখনো জানা হবে না। তুমি বেশ কিছুদিন আগেই কিভাবে যেন আমার থেকে অনেকটা দূরে চলে গেলে। কেন গিয়েছো সেটাই জানতে পারিনি আর কে বেশি শুভ্র সতেজ এটা কিভাবে জানব? মাত্র কয়েকটা বাড়ির দূরত্ব তবুও যেন শত আলোক বর্ষ দূরে। অসীম দূরত্বের তোমার ভূবনে তুমি সাদা আলোকময় হয়েই থাকো। দূর হতে আমি তারে সাধিব, গোপনে বিরহ ডোরে বাধিব।