Blog

জাগতিক হিসেব নিকেশ এর ব্যাপারে আমি কোনোদিনই তেমন পোক্ত ছিলাম না। খুব বেশি বুঝে শুনে, সলুক সন্ধান করে, সমঝে কাজ করি তেমন ধরনের মানুষ আমি না। কিন্ত এই আমি কেই তিনি অল্প কয়েকদিনের মাঝে বদলে দিলেন। তিনি খুব আহামরি ধরনের মানুষ না। একটা স্কুলের অংকের টিচার। আমার ছোট ভাই কে পড়ানো শুরু করেছেন অল্প কয়েকদিন। বয়স আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে। মাঝারি গড়নের এই মানুষটার পড়ানোর টেকনিক দুর্দান্ত। সে আমার ছোট ভাই কে সপ্তাহে তিনটে দিন অংক করায়। আমার ছোট ভাই এর রুমেই পড়ায়৷ যে দিন বাসায় গেস্ট থাকে, এবং আমার ছোট ভাই এর ঘর খালি থাকেনা সেদিনা আমার ঘরে এসে পড়ায়। সন্ধ্যার পর অফিস শেষ করে মানুষ নিভৃতে কাটাতে চায়, সুতরাং আমার ঘরে প্রাইভেট টিউশনের ঘরে পরিনত হলে আমার ভালো লাগার কথা না। আমি প্রথম দিন খুব বিরক্ত হয়েছিলাম৷ কিন্ত সেই বিরক্ত ভাব কেটে গেছে প্রথম দিনের অল্প কয়েক মুহূর্তের মাঝেই। মানুষটার মাঝে যাদু আছে। অংকের মত খটমটে বিষয় কে তিনি পানি ভাত বানিয়ে ফেলেন। এতো সুন্দর সব উদাহরণ দিয়ে বুঝান, অ্যান্ড খানিকটা অংক করিয়ে খানিকটা সময় গল্প করেন৷ উনার পড়ানোর টেকনিক আমার এতো ভালো লাগে যে মনে হয় আমিও খাতা কলম নিয়ে পড়তে বসে যাই৷ কিন্তু নিতান্তই ছেলে মানুষি ব্যাপার হবে বলেই বসা হয়না। তবে মনে মনে প্রায়ই চাই বাসায় গেস্ট থাকুক তিনি আমার ঘরে পড়াতে চলে আসুক। এই ভাবে কিছুদিন গেলো। তিনি আমার চেয়ে খানিকটা বড় হলেও সেম এইজই বলা যায়। আস্তে আস্তে আমাদের মাঝে ভালো সখ্যতা হয়ে গেলো। আমি উনার সাথে যাবতীয় ব্যাপারে আলাপ সালাপ করি। উনিও করেন৷ তবে আমার মত উনার জীবন না৷ খুব সিম্পল লাইফ উনার। বিয়ে হয়েছিল, বউটা অল্প দিনেই মারা গেছে। তবে উনি সেই শোক কাটিয়ে উঠেছেন অনেকটা৷ তবে নতুন করে বিয়ে শাদী করেন নাই৷ করার চিন্তা ভাবনাও নেই। স্কুলের মাস্টারী আর ফাকে ফাকে টিউশন করিয়ে তার আয় রোজগার খারাপ না। এরপরেও যুবক এই লোকটা বিয়ে শাদী, ঘর সংসার নিয়ে তেমন আগ্রহী না। তার সাথে আমার অল্প কিছুদিনেই ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠলো। তার পড়ানো শেষে নানা ব্যাপারে আলাপ হয়। যেদিন পড়ানো থাকে না সেদিন পাড়ার চায়ের দোকানে আড্ডা দেই। আমি গাধা শ্রেণির বলেই তার সিম্পল সব এক্সপ্লেনেশনে অল্পতেই মুগ্ধ হয়ে যাই। তার নলেজ লেভেল এর উপর এমনিতেই শ্রদ্ধা ভক্তি চলে আসে। এমন কোন বিষয় নেই যেটা নিয়ে তার সাথে আমার কথা হয়না। তবে তাকে আমি বিভিন্ন ব্যাপারে খুব চটকদার কিছু জানাতে পারি না। কারণ আমার নিজের নলেজ হাটু অব্দি। যা টুকটাক ওনাকে জ্ঞান মূলক কিছু বলতে পারি সেটা হলো বাংলাদেশের এক প্রকার প্রায় নষ্ট রাজনীতি নিয়ে। উনার এই ব্যাপারে জানাশোনা কম। আর আমি আবার নিয়মিত টং দোকানের লাল চা খেয়ে, টং দোকানের মাঝেই রাজনৈতিক আলাপ সালাপ করতে করতে এই ব্যাপারে দক্ষ হয়ে গেছি। উনি আমাকে প্রথম বুঝিয়েছেন মানুষের জীবনটাই গণিতে ঠাসা এই যে দেহ এই দেহের মাঝেও আছে গণিত, যেমন সব মানুষের মোট দৈর্ঘ্যকে তার পা থেকে নাভী পর্যন্ত দৈর্ঘ্য দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যাবে ১.৬১৮। এটা সব মানুষের জন্যই এক। ম্যজিক্যাল একটা নাম্বার এটা। সূর্যমুখীর ফুল থেকে শামুকের স্পাইনাল সব কিছুর মাঝেই কোন না কোন ভাবে এই সংখ্যা আছে। জগত সংসারে সব কিছুর মাঝেই অংক আছে। একটা কথা বললেও সেটার ইম্প্যাক্ট আছে। ভালো খারাপের হিসাব আছে, সেই লাভ ক্ষতির হিসাব আবার টাকা পয়সায় কনভার্ট করা যায়। এমন সব সিরিয়াস ধরনের কথা রেগুলার শুনতে শুনতে আমি নিজেও কেমন যেনো সিরিয়াস হিয়ে গেলাম। এমনই সিরিয়াস যে কথা বার্তা খুব সমঝে বলি, প্রতিটা মুহুর্তের দাম হিসাব করি। অল্পদিনেই এই পরিবর্তন অনেকের চোখে লেগে গেলো। এবং চোখে লাগার কারনেই সেই পরিবর্তন আবার পরিবর্তিত হয়ে আগের রূপে ফিরে গেলো। তার পিছনেও মাষ্টার মশাই এর হাত ছিলো। ব্যাপারটা খোলাসা করি। সেদিন আমার ছোট ভাই এর গণিত এর পরীক্ষা, বেচারা হঠাৎ করেই জ্বরে কাত হয়ে গেলো। এমনই সে জ্বর যে সে মাথা তুলতে পারেনা। আমি নিজেই প্রাইমারি ট্রীটমেন্ট হিসেবে তার মাথায় দুবার পানি ঢাললাম। তাতে উন্নতি বিশেষ হলো না। মাষ্টার বাড়ি এসে এটা দেখে ফিরে গেলো। সবাই বলছে এক্সাম দেবার দরকার নাই। ফাইনাল এক্সাম তো না যে দিতেই হবে। কিন্ত অসুস্থ শরীর নিয়েও সে এক্সাম দেবে। আমারই তো ভাই। ভাই যেমন অল্প দিনেই মাষ্টার এর স্পর্শে সকল ব্যাপারের হিসেব কষা শুরু করেছে, ঠিক তেমনি সেও হিসেব কষছে, এক্সাম না দিলে রোল পিছেয়ে যাবে। ম্যাথের একটা নোট তার বন্ধুর বাড়িতে ছিলো। আমি বের হলাম সেই মহার্ঘ বস্তু উদ্ধারের আশায়। তার বন্ধু কে একই মাস্টার পড়ায়। আমি অবশ্য কোনদিন সে বাসায় যাইনি৷ একটু হেজিটেশন নিয়ে বাসার ডোরবেল বাজালাম। দরজা খুলে দিলো অনিন্দ্য সুন্দরী এক রুপসী তরূনী। তার রুপের ঝলকানি তে আমার বুকজুড়ে উথাল পাথাল শুরু হলো। আমি তাকে নোটের কথা বললাম। আমাকে বসতে বলে সে আমার ছোট ভাই এর বন্ধু কে ডেকে দিলো। আমি তাদের ড্রইং রুমের সোফাতে বসে আছি। মাঝে মাঝে মেয়েটা এ ঘর ওঘর করছে। তার পায়ে নুপুর। সে যখন হাটে তাতে সেই নুপুরের এক ভুবন ভুলানো তাল লয় সৃষ্টি হয়। আমাকে তার ছোট ভাই নোট দিয়ে গেলো। আন্টি আমাকে চা খেয়ে যেতে বললেন। চা খাওয়ার প্রস্তাবে এতো ভালো লাগলো৷ যতটা সময় এই বাসায় থাকবো ঠিক ততটা সময় এই মেয়েকে দেখা যাবে। আমি চা খেয়ে চলে এলাম, আসবার সময় মেয়েটা আবার তাদের বাসায় যেতে বলল। নিতান্তই ভদ্রতা করে বলা এই কথা তে আমার যে কি অনুভূতি হলো সেটার ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব না। আমি বাসায় ফিরে এলাম। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট এর কেস ঘটে গেলো আরকি। আমার মাথায় সেদিন থেকে শুধু এই মেয়েই ঘোরে। আমি ছোট ভাই থেকে তার ইনফরমেশন কালেক্ট করা শুরু করলাম। মেয়েটা ঢাবিতে পড়ে, বাংলায়। খুব ভালো কবিতা আবৃত্তি করে। অনেক খুজে খুজে তার ফেইসবুক আইডি বের করলাম, রিকুয়েষ্ট দিলাম, সে ফলোয়ার বানিয়ে রেখে দিলো। আমি তাতেও খুশি। নিয়মিত তাকে দেখা তো যাচ্ছে, এই বা কম কিসে? অল্প কয়েকদিনের মাঝেই আমি মেয়েটার উপর এতোটাই ফলেন হলাম যে তাকে না দেখলে ভালো লাগেনা। অফিসে বাসায় ফ্রি থাকলেই তার আইডির ছবি দেখি, তার সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাপার খোজ নেই, আমার ছোট ভাই বিরক্ত হয়ে যায়, মাঝে মাঝে সে বলেই ফেলে আমার এতো আগ্রহ কেনো? আমি তাকে জবাব দিতে পারি না। খুব ইচ্ছে করে তাকে বলি, ” আরে পাগলা তোর ভাবী কে নিয়ে আগ্রহ আমার থাকবে না তো কি অন্য কারো থাকবে?” তবে তা বলা হয়না। এই ভাবে কিছুদিন গেলো, আমি ঠিক করলাম মেয়েটার সাথে প্রেম রিলেশন করা তো আমার দ্বারা হবেনা, সেই লেভেল এর স্মার্টনেস আমার নাই, এর চেয়ে ওয়েল উইশার দিয়ে ডিরেক্ট বিয়ের প্রপোজাল দেয়া বেটার, মেয়েটাও ফাইনাল ইয়ারে, বাসা থেকে বিয়ে দিতে অমত থাকার কথা না। কিন্ত কাকে দিয়ে বলাই, অগত্যা আমি মাস্টার কেই পারসোনালি ডাক দিলাম। সেও ফোনে বলল তার ও কি যেনো কথা আছে, আমাকেই নাকি তার উপকার করতে হবে। দুইজন মনের মাঝে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা নিয়ে দেখা করলাম। এই দেখা করাই আমাকে আমার পূর্বের জীবনে ফিরিয়ে দিলো। মাস্টার নিজেই সে মেয়েটাকে পছন্দ করে ফেলেছে, বিয়ের প্রপোজাল কেমনে দেবে এটা বুঝসে না, আমাকে সাহায্য করতে হবে। জাগতিক সকল অংক আমার মাথা থেকে উবে গেলো। আমি তাকে ডেকেছি কি জন্য আর সে এটা কি বলছে। আমি তাকে নানা ভাবে বুঝানোর ট্রাই করলাম- এই মেয়ে আপনার জন্য পারফেক্ট না, আপনি শিক্ষক মানুষ আপনার জন্য একটু অন্য পারসোনালিটির মেয়ে দরকার, আপনার সাথে মেয়েটার মানায় না। আপনার বয়স ওর চেয়ে বেশি। সে কোন ভাবেই আমার কথায় কনভিন্স হয়না। উলটা আমার আর তার বয়স যে সেম, এবং যে যদি বুড়া হয় আমিও সেম ভাবে বুইড়া এটাও বলল। ভগ্ন হৃদয় নিয়ে বাড়ি এলাম। মনের মাঝে একটাই আশা যে তার একবার বিয়ে হয়েছিলো, পত্নী গত হওয়া এই রকম একজনের সাথে রুপসী একটা মেয়ের বিয়ে হয়ত দেবে না। এই একটাই তার খুত, এছাড়া, সব দিক দিয়েই আমার চেয়ে এগিয়ে। তবে এই খুত ধোপে টিকলো না। আমাকে ম্যানাজ করতে না পেরে সে আমার মাকে ধরলো। আমার মা যেনো উঠে পড়ে লাগলেন এই বিয়ের জন্য। মা হয়ে গেলেন ঘরের শত্রু বিভীষণ৷ বাসায় থাকলেই আমার কোন কারন ছাড়া রাগ উঠে। মনে হলো মেসে সিট নিয়ে নেই। কিন্তু মেসের খাওয়া কোনদিনই ভালো হয়না এই জন্য সেই পরিকল্পনা বাদ দিলাম। চোখের পলকে সব ঠিক হয়ে গেলো। বিয়ের ডেট ফাইনাল। আমার মা, আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে কত উতসাহ উত্তেজনা। মাস্টার আমার রুমে পড়াতে আসলে আমার রাগ লাগে এখন। মনে হয় স্কেল দিয়ে তার মাথায় বাড়ি দেই। তাকে দেয়া নাস্তার মাঝে বিষ মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কোমল হৃদয় বলেই তা পারি না। ঠিক ডেটে বিয়ে হয়ে গেলো। রিসিপশন প্রোগ্রামে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাসার সকলের চাপাচাপিতে যেতে হলো। গলা দিয়ে কোন খাবারই নামছে না। আমার মা, বাবা, ছোট ভাই খুব উতসাহ নিয়ে ছবি তুলছে বর কনের সাথে আমাকেও অনেক বার বলেছে ছবি তোলার জন্য। আমার মনে হয়েছে সকলের কাছ থেকে ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে তুলে আছাড় দিয়ে ভেংগে ফেলি। অনেকটা সময় ধরে প্রোগ্রাম চলছে, নাচ গান হলো, মাস্টার নিজেও ছোট শালী, শালা, ছাত্র দের সাথে নাচলো, খানিকটা সময়। আমার রাগে অস্থির লাগছে। জগতের সকল কিছু গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। জগত থেকে গনিত, অংক, ম্যাথ হিসেব, সরল সুদ কষা সব উঠিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। বসে বসে এই সব ভাবছি এমন সময় কনে নিজেই আমাকে ডাক দিলো ছবি তোলার জন্য। সাধারণ গনিতের হিসেবে সুন্দরী মেয়েদের ডাক কোনদিন কখনো ফিরিয়ে দিতে হয়না। তবে আমি তো আর সেই বদলে যাওয়া আমি নেই, যে জাগতিক সব কাজে অংক কষতে হবে। আমি তার ডাক উপেক্ষা করে উঠে পড়লাম। আমার বাবা, মা, ভাই, মাস্টার সবাই ডাক দিচ্ছে, আমি তাদের বললাম- “বিনা কারণে ছবি তোলা ধর্মে নিষেধ আছে। রিলিজিয়াস প্রাকটিস মেনে চলার ট্রাই করছি।” আমার এরূপ জবাবে তীব্র হাসা হাসির রোল উঠে গেলো। আমি সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কোল্ড ড্রিংকস একটা বোতল হাতে নিয়ে বের হয়ে গেলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *