Blog

সন্ধ্যা থেকে ঝিরি ঝিরি একঘেয়ে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। ঝুম বৃষ্টি দেখার মাঝে একধরনের প্রশান্তি আছে, যে জল প্যাচপেচে কাদা সৃষ্টি করে সেই জল তরঙ্গ দেখবার মাঝে তেমন কোন আনন্দ নেই। তবুও জানালা খুলে বসে থাকা, মেঘ জলের এই খেলা দেখা চলছে। ধোয়া ওঠা এক কাপ চা অথবা কফি খেতে পেলে বেশ ভাল লাগতো, সেই উপায় নেই। হালকা বারী বর্ষণ কাজের বুয়া দের জন্য পারফেক্ট সিক লিভ বা সাধারণ ছুটি নেবার জন্য বড় ধরনের উছিলা। এক কাপ চা এর জন্য সমগ্র দেহ জুড়ে এক অদমনীয় কামনা, ফেসবুক ইন্সটাগ্রাম দেখে সেই কামনা দমিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছি, সেই চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছে, ইন্সটাগ্রামে মনে হয় কোন ছেলে মানুষের আইডি নেই, যে দু একটা আছে এরা টিক টক ধরনের সব ভিডিও করে আপলোড করছে, এছাড়া সব মেয়ে মানুষের আইডি, সেই আইডি আবার ভুবন ভুলে থাকা যায় এমন রুপময় তরূণীদের।এই সব তরূণীদেরকে দীর্ঘ সময় ধরে দেখলে নিজেকে কীটপতঙ্গ বলে মনে হতে থাকে, মনে হয় অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে টিকিয়া আছে আরশোলা, ঠিক আরশোলার মতোই টিকিয়া আছি। অগত্যা ইন্সতাগ্রাম দেখা বাদ দিলাম, সময় কাটাবার জন্য বই পড়া যেতেই পারে, আমি তাতে বেশ অভ্যস্ত, খুব আগ্রহ নিয়ে অনেক ঘাটাঘাটি করে ভুবন ভুলে থাকার মতো একটা বই খুজে বের করলাম অন্তর্জালের জগত থেকে। দুই চার পেজ পড়েছি, ভালো লাগা শুরু হয়েছে, ঠিক এমন সময় কোথা থেকে যেন খিচুড়ির ঘ্রাণ ভেসে ভেসে আসতে লাগলো, নিশ্চিত পাশের বাসায় বৃষ্টি দেখে খিচুড়ি রান্না করেছে, পাশের বাসার ভাড়াটিয়ার এই এক সমস্যা, বেছে বেছে আমার মন খারাপ করা বিষন্ন দিনে দারুণ সব খাবার রান্না করে, সেই ঘ্রাণে নিজের মাঝে এক ধরনের দুর্বার লোভ তৈরি হয়ে যায়, সেই লোভ কে অতি কষ্টে দমিয়ে রাখি, মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে তাদের দরজায় কড়া নেড়ে বলি-” আজকে এতো ভালো রান্না করেছেন আমাকেও এক বেলা নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান না, সব ধর্মেই অতিথি সেবা করার কথা বলা আছে”। নিতান্তই মধ্যবিত্ত মানুষ বলেই ক্ষুদ্র সম্মান ধরে রাখতে গিয়ে তা কোনদিন বলা হয়না। বই আর পড়া হবে না। মন বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো, এক পেয়ালা চা এবার খেতেই হবে, চায়ের নেশা বেশ কঠিন নেশা, কাম দমিয়ে রাখা যায়, ক্ষিদে দমিয়ে রাখা যায়, কিন্তু বাঙালির চায়ের নেশা দমিয়ে রাখা যায়না। বাইরে বৃষ্টী কিছুটা ধরে এসেছে। ছাতাটা কোথায় যেন আছে, খুজে খুজে সেটা বের করলাম, সেটার একটা ডাটি ভাংগা। সেই ডাটি ভাঙা ছাতা নিয়েই বের হলাম, রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে, সেই কাদা জল উপেক্ষা করে যতই চলার চেষ্টা করি তবুও কিভাবে যেন পা কাদা পানিতে মেখে যায়। সামনে এক বয়স্ক লোক হেটে যাচ্ছেন, জোর গতিতে এক রিকশা তাকে অতিক্রম করলো, চাকার কাদা ছিটকে তার পাজামা ভিজিয়ে দিলো, বুড়ো হলে কি হবে তার গলার জোর খানা খাসা, যে স্বরে সে “বানচোতের বাচ্চা” বলে গালি দিল, তাতে কোমল হৃদয়ের কারো ভয়ে ছোট ইয়ে হয়ে যেতে পারে। মুরুব্বির এই প্রতিবাদ দেখে খুব ভালো লাগলো, গালি দিক সেটা ব্যাপার না এই যে অন্যায় অনায্য এর বিপরীতে প্রতিবাদ কয়জন করতে পারে? তিনি হাটছেন আমি তার পিছে পিছে হাটছি। মুরুব্বি হঠাৎ থেমে গিয়ে পাজামার চেন খুলে খাম্বার পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন, যে জোরে চিৎকার দিয়েছেন তাতে এই বয়সে ছোট ইয়ে পেয়ে যেতেই পারে। তিনি তার মতো বারী বর্ষন করতে থাকুন, আমি এগুই। চায়ের দোকানে চলে এলাম, তেমন ভীড় নেই। দুজন বসে মোবাইলে লুডু খেলছে, অতি সসম্প্রতি লূডুর চল বেড়েছে, কম বেশি সবাই খেলছে, তবে বাঙালি তো ক্রিয়েটিভ জাতি, তারা তাদের ক্রিয়েটিভিটী কাজে লাগিয়ে এই খেলা কে জুয়ার কাতারে নিয়ে গিয়েছে, এখানে অবশ্য জুয়া হচ্ছে না। চায়ের দোকানে বসে অনেকটা সময় ধরে চা খেলাম পর পর দুই কাপ। মনে হচ্ছে আর এক কাপ খাই, তিন নম্বর কাপ নেব কিনা এটা ভাবতে ভাবতেই আট ন বছরের একটা ছেলে এলো, তার উর্ধাঙ্গে কোন কিছু নেই, প্রায় পুরোটা শরীর ভেজা, তার মুখ জুড়ে অদ্ভুত মায়া, সেই মায়া নিয়েই সে আমার কাছে কিছু টাকা চাইলো সে নাকি সকাল থেকে না খাওয়া, আমার খুব খারাপ লাগলো আহারে বাচ্চা একটা ছেলে না খেয়ে আছে, তাকে আমি অল্প কিছু টাকা দিয়ে দিলাম, সে সেটা নিয়েই ছুট লাগালো, চায়ের দোকান দার বলল- এদের টাকা দিতে নাই, এরা হয় ড্যান্ডি খাবে, না হয় বাজি টাজি খেলে টাকা নষ্ট করবে। আমি বের হয়ে এলাম। এখন আর বৃষ্টি নেই, আকাশে মেঘও নেই, ফুটপাত ধরে হাটছি, লোকজন তেমন নেই, একটু এগুতেই এক মহিলা কে দেখলাম ফুটপাতের পাশেই ছোট একটা চুলা জ্বালাবার চেষ্টা করছে, তার পড়নে মলিন শাড়ি, তার দুটো ছোট ছোট বাচ্চা ফুটপাতের কাদা জলে গড়া গড়ি খাচ্ছে, একজন কেদে চলেছে তারস্বরে, তাদের মা তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপহীন। চুলাটা না জ্বললে এক ফোটা ফ্যান ও পেট অব্দি যাবে না। খুব খারাপ লাগলো, জগত এমন কেন? এতো দুঃখ এতো দৈন কেন চারপাশে? খানিক এগুতেই খালি গায়ের সেই ছেলে কে দেখলাম, তার হাতে জলন্ত সিগারেট, আমাকে দেখেই সে দৌড় দিল। আমার আরো বেশি খারাপ লাগলো এটা দেখে। আমি আর কোন দিক না তাকিয়ে দ্রুত হেটে বাসার কাছে চলে আসছি, সিড়ি বেয়ে উঠছি, সিড়িতে তন্বীর সাথে দেখা, সে কোথাও বের হচ্ছে, তার পড়নে শাড়ি, মন ভালো করে দেয়া পারফিউমের সুবাস আসছে , ত্বন্বী এই বাসায় ভাড়া থাকে, অবিবাহিত, বেশ ভাল একটা চাকরি করে, তার সাথে হাই হ্যালো ধরনের চেনা জানা আমার, এই মেয়েটাকে আমার এতো ভাল লাগে, কিন্ত মধ্যবিত্ততার শিকলে বাধা আমি কখনই তা প্রকাশ করতে পারি না, তাকে দেখে আমার বুকে সুখের মতো ব্যাথা শুরু হল, সে আমাকে দেখে একটা হাসি দিল, সেই হাসি আমার ব্যাথা বাড়িয়ে দিলো আরো অনেকটা। বুকে এক রাশ সুখের ব্যাথা নিয়ে আমি সিড়ি বেয়ে উঠি, মনে হয় অনন্ত সময় ধরে সিড়ি বেয়ে চলেছি, একটা সময় সিড়ি শেষ হয়, আমি চাবি টা কি হোলে ঢুকিয়ে দরজা খুলি এমন সময় পাশের বাসার দরজা খুলে যায়, পাশের বাসার ভাবী বলেন- আপনি মাত্রই এলেন, এর আগে একবার নক করে গিয়েছি, দরজা খোলা রাখেন, আসতেছি। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকি, তিনি ধোয়া ওঠা এক প্লেটে খিচুড়ি আর বাটিতে গরুর কালো ভুনা দিয়ে যান। এতোটা সময় বাদে আমার সত্য সত্য ভালো লাগা শুরু হয়, মনে হয় জগতে এখনো মানবতা আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *