বাকি রাখা খাজনা
মোটে ভাল কাজ না
যদি না সময়ে উঠিল খাজনা, মাশুল, কর
কেমনে ভরিবে মুঘল বাদশাহ এর ঘর
উপরের ছন্দটা বা nonsense rhyme টা শুনতে খুব একটা ভাল না। এর মূলভাব টাও খুব সুন্দর কিছু তাও না। একদা ভারতবর্ষের মহামহিম শাসনকর্তার মাথায় এইরকম কিছু চিন্তা আসে, ছন্দ আকারে না আসলেও অর্থটা ঠিক থাকে এইরকম কিছুই এসেছিল। মহামহিম সেই শাসনকর্তাকে ভারতবর্ষের আবাল- বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই চেনেন। তিনি গত হয়েছেন অনেক পূর্বেই কিন্তু তার চিন্তাধারা রয়ে গেছে। facebook এর পাঠক হয়ত এতক্ষণে ধরে ফেলেছেন আমি কার কথা বলছি। আমি বলছি মহামতি বাদশাহ আকবরের কথা। অনেকে অবশ্য তাকে ভক্তি ভরে ইংরেজীতে Akbar the great বলেন।
সঠিক সময়ে খাজনা, রাজ্য পাওনা প্রজাদের থেকে তোলার জন্য সম্রাট ভাবনা, চিন্তা করলেন।সে কালে পূন্যাহ বলে একটা আচার অনুষ্ঠান এই সালতানাতে ছিল। সম্রাট সেটা কাজে লাগিয়ে একটা নতুন বর্ষপঞ্জি করার চিন্তা করলেন। শাসকগণ যা ভাবেন তা করেন। যেটা স্থায়ী প্রথার রূপ নেই।এক কথায় সম্রাটের ইচ্ছাই সকলের কাছে আদেশ।ডাকা হল সেই সময়ের বিখাত জ্যোর্তিবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেউল্লাহ সিরাজীকে। তার হাতেই নির্মিত হল সৌর সাল ও আরবী সালের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সাল। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ বাংলা সাল গণণা শুরু হলেও গণনা পদ্ধতি কার্যকরী করা হয় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ থেকে সম্রাট এর সিংহাসন আরোহনের সময় থেকে।
বাংলা সনের প্রথম দিন কে নববর্ষ হিসেবে ধরা হয়।এই দিনের পূর্বে অর্থাৎ চৈত্রের শেষদিন আদায় করা হয় খাজনা-মাশুল-শুল্ক এবং এর পরের দিন অর্থাৎ নববর্ষের দিন কিছু আনন্দমুলক আচার অনুষ্ঠান হত। তবে পূর্বের দিন বাধ্যতামূলক খাজনা, মাশুল পরিশোধ করে প্রজারা কতটা আনন্দ করতেন তা নিয়ে রয়ে গেছে মতবিরোধ। ভারতবর্ষের শাসকগণ খুব উদার প্রকৃতির ছিলেন এবং প্রজাবতসল ছিলেন এমনটা শোনা যায়নি কোন দিনই। সুতরাং সেই পরিশোধকৃত খাজনা মাশুল শুল্কের সাথে কতনা দরিদ্র মানুষের হাড় ভাঙ্গা খাটুনির ঘাম, রক্ত মিশে আছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।সেই আমলে ধনী দরিদ্র ভেদে খাজনা মাফ এর কোন গল্প আজ অবধি শোনা যায় নি, তবে খাজনা সঠিক সময়ে নেবার জন্য অত্যাচারের ভয়ংকর গল্প আমরা শুনেছি অনেক। কতনা অশ্রুজল মিলে মিশে এক হয়ে আছে এই বাংলা সনের জন্মে তার ইতিহাস আমরা ভুলেই গেছি।
নববর্ষে যে উতসব হত না তা নয়, কিছু জমিদার এবং ধনী কিছু প্রজা উতসব ঠিকই করতেন। ব্যবসায়ীদের জন্য “হালখাতা” নামক একটা খুব সুন্দর গোছানো জিনিস হত,সেটা কালের প্ররিক্রমায় এখনও চলছে। তবে আমরা ভুলে গিয়েছি খাজনা দিতে না পারা দরিদ্র প্রজার অশ্রুজলের ইতিহাস।
আধুনিক নববর্ষে প্রথম পালিত হয় ১৯১৭সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর ১লা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পুজার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৮-১৯৩৯ সালেও অনূরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়।
যাক গে বাদ দেই সে কথা, আমরা ব্রিটিশ এর শিকল ভেঙ্গে চলে যাই পাকিস্তানীদের কাছে, পশ্চিমে অবস্থিত(বাংলাদেশ থেকে) এই দেশের শাসকগণ ছিলেন চুড়ান্ত রকমের নির্বোধ। অযথায় বাংগালীদের যে কোন কিছুতে বাধা দেয়া ছিল তাদের মজ্জাগত অভ্যাস। তাদের কারণেই সেই সময়ে নববর্ষ উতসবটা ঠিকমত হত না। এগিয়ে এল ছায়ানট নামের এক সংগঠন। ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথের “এসো হে বৈশাখ “ গান দিয়ে সূর্যদয় এর সময় থেকে নববর্ষ পালন শুরু করল। এই সংগঠনের প্রধান সমস্যা তারা বাংগালির সংস্কৃতি বলতে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া যে অন্য কিছু রয়েছে তা মানতে নারাজ। দিনভর রবীন্দ্র জপ করে তাদের মত করে উতসব পালন করতে থাকল। এদিকে বাংগাল মূলক নিয়ে ঢের ঢের কবিতা গান লেখা সাহিত্যিক গণ হলেন উপেক্ষিত। ছায়ানটের এর সেই অনুষ্ঠান এ জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত, নজরুল বরাবর বেমানান ছিলেন আজ অবধি আছেন। তারা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারো গলায় মাল্য দিবেন না। facebook এর পাঠকদের জন্যে একটি তথ্য- রমনা বটমুলে ছায়ানট এর শিল্পীরা যে বৃক্ষ তলে বসে “এসো হে বৈশাখ “ গান করেন সেটি কিন্তু বটগাছ নয়। সেটি অশ্বথ গাছ। দেশ স্বাধীন হবার পরে পহেলা বৈশাখকে পার্বণ ঘোষনা দেয়া হয়। এবং সরকারী ছুটি ঘোষনা করা হয়। ঢাকাতে কিছুকাল পরে শুরু হয় ঘটা করে বৈশাখ পালন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ মঙ্গোল শোভাযাত্রা নামক একটি মিছিল, গণ পদ যাত্রা করে যাতে রং বেরঙ্গের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর বড় বড় প্রতিলিপি এ দেখতে পাওয়া যায়।অতি সম্প্রতি এই পদ যাত্রা ইউনোস্কোর স্মীকৃতি পেয়েছে। ১৯৮৯ সালের দিকে এটি শুরু হয়। এছাড়া নববর্ষের সকালে পান্তা ইলিশ খাওয়া একটা রীতি চালু হয়েছে। অনেকেই এটি গুরুত্বের সাথে নেন নিজের বাংগালীয়ানা দেখানোর জন্য যদিও বাংগালি ও পান্তা ইলিশ এর মিলন কিভাবে কোথায় হয়েছে জানা নেই।
বাংলাদেশ ছাড়াও কোলকাতা, আসাম, মনিপুর, ত্রিপুরাতে এটা পালন হয়। কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে এইদিন ভীড় হয় প্রচুর, দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা ও নববর্ষের সূচনা করেন কোলকাতা বাসী। তারা ঐতিহ্যবাহী ধূতি, পাঞ্জাবী ও শাড়ী পড়েন এই দিনে।
হিজরী সনে প্রথম দিন গণনা হয় সন্ধ্যা থেকে , ইংরেজী সনে রাত বারোটা থেকে আর বাংলা সন হত সূর্যদয় থেকে। তবে বাংলা একাডেমী বাংলা সন গণনা ১৪০২ সালে পরিবর্তন করে রাত বারোটা থেকে গণনার নিয়ম চালু করেছে।
মজার একটা ব্যাপার হল দক্ষিণ ভারতে একই দিনে নববর্ষ পালিত হয়। ওদের সাথে আমাদের মাসের নামেরও অদ্ভুত মিল রয়েছে। বিদাগ(বৈশাখ), জেঠ(জৈষ্ঠ্য), আ’ঢ়(আষাঢ়), শাওন(শ্রাবণ) ইত্যাদি।
শুধু পহেলা বৈশাখ এ পান্তা ইলিশ আর মঙ্গল শোভাযাত্রা করেই যেন আমাদের বৈশাখী উদযাপন শেষ না হয়। কারণ এই দিনের সাথে বহু দীন হীন মানুষের খাজনা শুল্ক দিয়ে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হবার অশ্রুজল মিশে আছে। আমাদের মাটির ভাড়ের পান্তা ইলিশের জলে তাদের সেই অব্যক্ত অশ্রুজল মিশে আছে তা যেন আমরা ভুলে না যাই।
সকলের প্রতি রইলো বাংলা নববর্ষের একরাশ শুভেচ্ছা। বাংলা নতুন বছর শুভ বার্তা বয়ে আনুক সকলের জন্যই।