বহুদিন বাদে এক শান্ত স্নিগ্ধ, উদাস বায়ু বয়ে যাওয়া বিকেলে বেইলী রোডে তাকে দেখলাম। সে আমাকে দেখেনি। সুন্দরী মেয়েরা সাধারণ ছেলেদের দিকে তাকায় না। অতি সাধারণ এই আমি কোন এক পূণ্যের দরূণ একটা সময় তার হাত ধরে হেটেছি দীর্ঘ সময়। সেই সময় বদলে গিয়েছে। তারও সময় বদলে গিয়েছে। তবে তার মাঝের মোহনীয় মাধুর্য কমেনি। সেই টানেই কথা বলবনা, বলবনা ভেবেও অমোঘ এক আকর্ষণে তাকে পিছন থেকে ডাক দিলাম। সে তখন সিড়ি ভেঙে ওভার ব্রীজে উঠছে। আমার ডাকে সে থামল। বহুকাল বাদে আমাকে দেখলো সে। খানিকটা সময় নিয়ে দেখে মৃদু মোলায়েম এক হাসি দিল। কথা বলতে বলতে ওভার ব্রীজে উঠলাম, ব্রীজের উপরে একেবারেই ফাকা, আশে পাশে দু চারটা কম বয়সী ছেলে মেয়ে বেশ কাছাকাছি গা ঘেষে দাঁড়িয়ে গল্প করছে, খুব নজর না দিয়েও বোঝা যায় তাদের মাঝে গভীর এক প্রেম। সব প্রেমই গভীর, সুন্দর, শাশ্বত ভেঙে যাবার আগ অব্দি। আমরা এক ধারে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, কথা বলতে বলতেই তাকে বললাম, “অনেকদিন তোমার কবিতা শুনিনা একটা কবিতা শোনাবে আজকে?” জীবনানন্দের সেই কবিতাটা, “আমাকে খোজোনা তুমি বহুদিন” সে বেশ কঠিন গলায় বলে -“আমি এখন কবিতা আবৃত্তি করিনা।” আমার মন খারাপ হয়ে গেলো এই এক কথাতেই, মন খারাপের সেই ভাব আমার চেহারার মাঝে চলে এলো। সুন্দরী মেয়েরা মাঝে মাঝে আমার মতো ছেলেদের জন্য করূণা দেখায়, সেই করূণা থেকেই সে বলল-” রিসেন্টলি রবীন্দ্র সংগীত শিখছি শুনতে চাইলে গাইতে পারি।” ঢাকা শহরের ওভার ব্রীজে অনেকেই অনেক কিছু করে তাই বলে কোন সুন্দরী মেয়ে রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে শোনায় না, বিষয়টা অড হলেও আমি তাকে গাইতে বললাম। সে খালি গলায় গাইলো- “ওহে কি করিলে বল পাইব তোমারে, রাখিব আখিতে আখিতে।” তার মতো মেয়ের গলায় অতি আবেগ দিয়ে গাওয়া এই গান শুনলে যে কোন ছেলে প্রথম সমুদ্র জল দেখে কিছু না ভেবেই যেভাবে ঝাপ দেবে, সেভাবে ঝাপ দিয়ে প্রেমে পড়ে যাবে। আমি বহু আগেই সেই ঝাপাঝাপির দিন পার করে এসেছি। বুকে খানিকটা ব্যাথা উঠলো তার জন্য সেই ব্যাথাকে উপেক্ষা করে আমি জীবনানন্দের লেখা দুটো লাইন
বললাম-
“প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়”।
বলেই আর দাড়ালাম না। হাটা ধরলাম। পিছে তাকিয়ে তার মুখের অভিব্যাক্তি দেখবার খুব ইচ্ছে করছিলো, ব্যাকুল সেই ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে আমি হাটি। সে পিছন থেকে বার দুয়েক নাম ধরে ডাক দেয়, আমি ফিরেও তাকাই না। তাকিয়ে কি হবে নক্ষত্রের যেমন মৃত্যু হয়ে যায় আমার অনুভূতিরও মৃত্যু হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। এখন আর কারো পানে না তাকালেও চলে।