Blog

ঢাকা শহরে আমার সব চেয়ে পছন্দের জায়গা ধানমন্ডি লেক পাড়। বেশ ছিম ছাম জায়গা। তবে মোটেও নিরিবিলি নয়। এই শহরে আমি আমার জীবনের যে কঠিন হতাশার সময় কাটিয়েছি তখন সেই খারাপ চলা সময়ে এই জায়গাটায় গেলে তেমন কোন কারন ছাড়াই আমার ভাল লাগত। আমি সময় সুযোগ পেলে এখনো এখানে আসি। লেকের পানি খুব বিশুদ্ধ স্বচ্ছ নয়, নির্জনতায় পরিপূর্ণ নয় পুরোটা এলাকা, অথবা খুব বেশি পরিচ্ছন্নও নয় তবুও আমাকে এই জায়গাটা টানে। এই লেক পাড়ে কত কি যে হয়, তরুনের দল ছোট করে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলে, প্রেমিক প্রেমিকার হাত ধরে ঘোরা দেখতে ভাল লাগে, বয়স্ক মানুষ দের সান্ধ্য ভ্রমন দেখতেও ভাল লাগে। এই জায়গাটায় আমি একটা সময় প্রায় প্রতিদিন সন্ধাবেলায় যেতাম। দস্তুর মত আড্ডা দিতাম। হৃদয় জুড়ে হাহাকার যতই থাকুক আড্ডা দিলে তখন মন দিল ঠান্ডা হত। এই লেকপাড় আমার কাছে মনে রাখবার মত হয়ে আছে অনেক কারনেই। এখানে আমি আজব সব মানুসষের সাথে পরিচিত হয়েছি। একদিনের পুরিচয়ে মানুষ কতটা আপন হতে পারে তা দেখছি। সেই আপন ভাব যে আবার কিয়ৎকালেই ভুলে যাওয়া যেতে পারে তাও দেখেছি। আমার ব্যক্তিগত ভাবে ম্যাদামারা মানুষ খুব অপছন্দ। পৃথিবী জুড়ে দুঃখ, হতাশা ছাড়া মানুষ পাওয়া যাবেনা। তাই দিন খারাপ যাচ্ছে বলেই যে ম্যান্দামারা ভাবে পড়ে থাকতে হবে এই ব্যাপারটা আমার কোন কালেই ভাল লাগেনি। ধানমন্ডি লেকপাড়ে আমি সে সময় যাদের সাথে আড্ডা দিতাম তারাও আমার মতই প্রবল হতাশা গ্রস্থ। কিন্তু আড্ডার সময় কেউ যখন তাদের দুঃখ গুলো শেয়ার করত আমরা কেন যেন ঠিক দুঃখ পেতাম না। বরং চাপা আনন্দ হত। পরের দুঃখে যদি আপনি সুখ না পেলেন তবে বুঝতে হবে আপনি ঠিক আসল বাংগালী নন। যাই হোক আমার এক বন্ধু ছিল সংগত কারনে নাম বলব না। টুক টাক রাজনীতি করত এবং প্রায়শই বিচিত্র সব মানুষকে আমাদের আড্ডায় নিয়ে আসত। রাজনীতি করত বিধায় সে কখনই অর্থনৈতিক ভাবে পর্যুদস্ত কাউকে আনত না। যাদের নিয়ে আসত তাদের হাত উল্টালে বেশ ভাল পয়সা কড়ি পড়ে যায়। এবং আমরা কেউই সেই পয়সা কড়ির লোভ না করলেও সে নিজেই সেই পয়সার উপযুক্ত ব্যাবহার করত। অন্যের পয়সায় ফূর্তি না করতে পারলে রাজনীতি করবার মানেই হয়না। সে যাইহোক আমার এই বন্ধুটি একদিন একজন কে নিয়ে আসল। যাকে নিয়ে আসল সে মানুষ নাকি সোনার তাল তা ঠাহর করতেই আমার বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। লোকটার বয়স চল্লিশ প্লাস। দেখলে আরো বেশি মনে হবে। সম্ভবত বাপ্পি লাহিড়ী এর ভাই টাই কিছু একটা হবে। এটা বলছি এই কারণ য়ার হাতে সোনার ব্রেসলেট, কানে বড় সোনার দুল। গলায় জাহাজ নোঙর করার মত মোটা সোনার চেইন। সব চেয়ে অবাক হলাম তার হাসি দেখে। তার দুটো দাত সোনার। তিনি নিজেই বেশ উতসাহ নিয়ে দেখালেন। আমার খুব ইচ্ছা হল দাত দুটোর ছবি তুলে রাখার। নিতান্তই অপরিচিত মানুষ তাই করা হল না। উনার সাথে আলাপে যা বুঝলাম উনিও আমাদের মতই দুঃখি মানুষ। তার পকেট ভর্তি অর্থ, কিন্তু সেই ভাবে ভোগ বিলাসে লাগছে না। তিনি চান আমাদের মত পঁচিশ বছরের যুবকদের মত করে ঘুরতে, ফিরতে, চলতে ইচ্ছে মত টাকা উড়াতে কিন্তু তার আফসোস তাকে সংগ দেবার কেউ নাই। তিনি আমাদের সাথে খুব বেশি সময় বসলেন না। অল্প সময় এই ধৈর্যহারা হয়ে পড়লেন। তখন শীতের দিন। আমরা দীর্ঘ সময় আড্ডা দেই কাজ কাম না থাকার দরূন। কিন্তু উনি অস্থির মতি মানুষ তার এই গা ছেড়ে বসে খেজুড়ে আলাপ ভাল লাগবে না।

শিতের দিন, কথায় কথায় খেজুররস এর কথা আসল। আমাদের সোনা বাবুর মাথায় ঢুকল খেজুরের রস খাবার ব্যাপার। তিনি ততক্ষনাত প্রস্তাব দিলেন খেজুর রস খাবার। খাটি রস খাবেন বাবু সাহেব। তিনি যেতে চান গ্রাম সাইডে যে খানে খাটি রস পাওয়া যাবে। তার গাড়ি আছে। উনার সাথে চারজন যেতে পারবে। আমরা মোট ছয় জন। আমি শুরুতেই না বললাম। হুদাই তেল পুড়িয়ে বাইক টেনে সাভার যাবার প্রশনি উঠে না। আর খেজুররস এমন কোন মহার্ঘ্য বস্তু নয় যেটা খেতে রাত করে সাভার যেতে হবে। আমি শুরুতেই না বলে দিলাম। কিন্তু বিধি বাম। আমি না গেলে একজন কে থেকে যেতে হয়। আমি যুক্তি দিলাম খেজুররস খাবার উপর্যুক্ত সময় ভোরবেলা। রাতে হুদাই ঘুরে আসা হবে। এবার আমাদের সোনা বাবু নিজেই আমাকে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন। মুরুব্বি মানুষের কথা ফেলা যায়না। বেজার মুখে রাজি হলাম। অনিচ্ছাকৃত যাত্রায় আনন্দ থাকেনা। আমার আরো বেশি ভয় লাগছে এটা ভেবে আমরা যারা যাচ্ছি এরা যে সুযোগ পেলে বাংলা তাড়ি মাড়ি খাবেনা তার নিশ্চয়তা কম। ফ্রিতে বাংগালী আলকাতরা খায় আর এটা তো তাড়ি। মাতাল দের নিয়ে বাইক বলেন, গাড়ি বলেন আর প্লেন বলেন কোনটাই নিরাপদ না। আমি তাই আমার পিছনের জন কে বল্লাম

– শোন অই খানে গিয়ে কোন নেশা ভাং খাবি না

– আজব ব্যাপার কেউ খুশি হয়ে খাওয়ালে না করব কেন?

– না করবা কারন নিজে ড্রাইভ করে ঢাকা ফিরতে হবে।

– তুই খাবিনা তাহলেই হবে। তুই বাইক চালাবি তুই খাবিনা। কাহিনি শেষ। আর তুই এমনিতেও খাবিনা জানি। তোর অমৃতে অরুচি আছে এটা আমি জানি।

আমি বুঝে গেলাম এদের রাত করে সাভার জাবার আগ্রহের কারন। বারণ করে লাভ নেই। প্রবল হতাশাগ্রস্থ বাংগালী যুবক শ্রেণী অং বং খেয়ে ভং করবে এটা স্বাভাবিক। আর তাও ফ্রিতে খাওয়া৷ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মানা করলেও তারা শুনবে না। অগত্যা বারণ করা বাদ দিলাম। আমিন বাজার ব্রীজ ক্রস করে একটু সামনে গেছি, আমাদের সাথের গাড়ি আমাদের আগে আগে গেছে। আমি দুর থেকে দেখতে পেলাম টহল পুলিশ গাড়ি আটকেছে। আমার বন্ধুও দেখেছে ব্যাপারটা। সে আমাকে থামতে বলল। আমি তো জানি থামলেই পুলিশের কাছে আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রকট। আমি বন্ধুর কথায় পাত্তা না দিয়ে না থেমে এগিয়ে গেলাম। পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাড়ালাম। বন্ধুকে বল্লাম ফোন দিতে। বন্ধু ফোনে কথা বলছে। কথোপকথনে যা বুঝতে পারছি তাতে অবস্থা বিশেষ সুবিধার না। বন্ধুও ফোন কেটে দিল। আমাকে বলল

– দোস্ত না থেমে ভালো করছোস। ওদের পুলিশে আটকে দিছে। হালার পুতের ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই৷ ড্রাইভার ড্রাইভ করে৷ আজকে নিজে নিয়ে বের হয়ছে। গাড়ির কাগজ ড্রাইভার গাড়ির কোন চিপায় হান্দায়ছে তাও খুজে পায়তাছেনা। ড্রাইভার হালায় ও ফোন ধরেনা। পড়ছে বিপদে। গাড়ি রেকারে দিবে৷ আর ওদের সন্দেহভাজন হিসেবে থানায় নিবে।

আমি শুনে হাসি চেপে রাখতে পারিনা। খেজুরের রস থানায় যে কোন দিক দিয়া ভরে দেবে সেটা ভেবে হাসি আসছে। হাসি চেপে বলি

– নেতা কি কয়, হে না রাজনীতি করে, ওই তো পুলিশ ম্যানাজ করে ফেলতে পারে।

– আর ম্যানাজ। নেতা চ্যাত দেখায়ছে প্রথমে, এরপরে ওরে পুলিশে থাবড়ায়ছে। ডিউটি অফিসার মনে হয় অনেষ্ট বেশি৷ আমাদের সোনা মশাই তো টাকা পয়সা দিয়ে ছাড়ায়ে নিতে পারে। পুলিশ নাকি রাজি না।

– তাহলে আর কি। বসে ওয়েট করি। ওরা না আসলে আমরা ব্যাক যাব।

বন্ধুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। আমার ভিতরে ভিতরে চাপা আনন্দ। রাত করে রস খাবার রস এখন বুঝবা থানায়। আমারা ঘন্টা খানেক ওয়েট করি। বন্ধু ফোনে যোগাযোগ করবার ট্রাই করে। কেউ ফোন ধরেনা। মনে হয় পুলিশ ফোন কেড়ে নিসে। আমরা ফিরতি পথ ধরি। বন্ধু আমার ম্যাদা মারা হয়ে যায়। রাতের বেলা রাস্তা ফাকা তাই দ্রুতই ঢাকা ফিরে আসি। পরবর্তী কাহিনি হালকা করে শুনেছি। লজ্জাজনক কাহিনি তারা কেউ বুক চিতিয়ে বলবে না এটাই স্বাভাবিক। অনেক খোচা খুচি করে যা জেনেছি তার সামারি হল সেদিন গাড়ির কাগজ ড্রাইভিং লাইসেন্স না পেয়ে পুলিশ তাদের চার্জ করে। সকলেই তরুন, রক্ত গরম তাই বীরত্ব দেখাতে সকলেই চেয়েছিল। ফল হয়েছে উল্টো। পুলিশ নিজেই বেশি বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে। সকলের পশ্চাতদেশে ছাপ ফেলে দিয়েছে। কারো মুখমন্ডল এও হাতের পাচ আঙুলের ছাপ পর্যন্ত পড়েছে। এছাড়া এক দিনের হাজত বাস তো আছেই৷ সব চেয়ে বেশি ইফেক্ট রাজনীতি বিদ বন্ধুর উপর গেছে। সে পুলিশের বাটাম তো খেয়েছেই এবং বিপদ কালে সকলকে উদ্ধার করতে না পারার দরুন সকলের ভতসনা তো আছেই। সব শুনে আমার বেশ আনন্দ হয়। হাজত বাস আর কটা দিন বেশি হলে ভাল হত। ফ্রী তে হাবি জাবি খাবার শখটা মিটে যেত। আমি তাদের দুরবস্থা নিয়ে মজা করি। তারা রাগ করে। আমি কিছু মনে করিনা। বন্ধুর এই ধরনের ছোটখাটো বিপদে মজা না পেলে বাংগালি হিসেবে আমার পরিচয় বৃথা হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *