দীর্ঘ ক্লান্তিময় একটা দিন পার করলাম অফিসে। আজকেই শেষ অফিস। চারদিকে মানুষের ঘরে ফেরার টান। আমার তেমন কোন টান নেই। আমার সাথে বাসার ভাই, আর আরিফ ভাই নামলেন, তাদের মাঝেও ঘরে ফেরার টান নেই। তাদের বাসা ঢাকাতেই। আমরা ক্লান্তি দূর করতে মোটামুটি দেখে একটা চায়ের দোকানে ঢুকলাম। টং দোকানের আপগ্রেড ভার্শন আর কি। বসার জন্য বেঞ্চের বদলে প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল আছে। ঈদের আগে আগে বলেই দোকানে তেমন ভিড় নেই। আর দু জন কাস্টমার আছে এরা আপন মনে তাস খেলছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে জগতের সমস্ত আনন্দ বেদনা সুখ বায়ান্ন টা কাগজের মাঝে বন্দী। আজকাল কাউকে মন দিয়ে কিছু করতে দেখিনা। এদের দুই জন কে দেখে ভালো লাগলো। তাস টা তো তাও মন দিয়ে খেলছে। গড মাস্ট বি ক্রেজি সিনেমাই এই রকম দুজন কে দেখেছিলাম যারা জগত ভুলে তাস খেলতো। দোকানের টিভি তে বিটিভি চলছে, আজকাল বিটিভি দেখাই হয়না। বিটিভি তে পদ্মা সেতু বিষয়ক ডকুমেন্টারি দেখাচ্ছে। সুন্দরী একটা মেয়ে পুরো ব্যাপারটা এক্সপ্লেন করছে। শুধু এই মেয়েটার উপর আকৃষ্ট হয়েই বিটিভির পর্দার উপর আমার চোখ আটকে গেলো। আরিফ ভাই, বাশার ভাই নিজের মাঝে আলোচনায় মত্ত। তাদের আলোচনা এক ধরনেরই, হয় বাচ্চার এই প্রবলেম, নাহয় ভাবী আজকে এটা করেছে, না হয় বাসার বুয়ার কেচ্ছা। এর চেয়ে বিটিভীর সুন্দরী কে দেখার মাঝে একটা প্রছন্ন সুখ আছে। দোকানদার আমার চেয়েও বেশি মনোযোগ দিয়ে দেখছে। সে কি পদ্মা সেতু তে মুগ্ধ নাকি আমার নতই সুন্দরী বংগ ললনার রুপে মুগ্ধ এটা বুঝতে পারছিনা। এমনিতেই কাস্টমার কম এরপর যা দু একজন আসছে তাতে সে যারাপনাই বিরক্ত মুখে দব্যাদি হস্তান্তর করছে। বাশার ভাই কফির অর্ডার করতেই সে বলল “কফি নাই”, বাশার ভাই চা চাইতেই তার মুখ কালো হলো। সুন্দরী ললনার মুখশ্রী বাদ দিয়ে চা ঘুটার মাঝে তেমন আনন্দ নেই এটা বুঝা যায়। অত্যন্ত বিরক্ত মুখে চা বানাচ্ছে সে। সিগারেট চাইতেই তার মুখ আরো কালো হল। সে মনঃসংযোগ ধরে রাখতে পারছে না। সিগারেটের ব্যান্ডে গন্ডগোল বাধিয়ে ফেলে বাশার ভাই থেকে একটা কড়া ধমক খেলো। বাশার ভাই এর মাথা এমনিতেই গরম আছে, ম্যানাজার থেকে সকালেই একটা ধাতানি তিনি খেয়েছেন। এরপর ঈদ যাত্রায় সত্যিই মোটর সাইকেল বন্ধ এটা শুনে আরো মাথা গরম হয়ে আছে। অফিসের বাইক থাকা কলিগদের নিয়ে অফিসের সামনেই ছোট করে একটা মানব বন্ধন করার প্লান করেছিলেন। কোন এক অদ্ভুত কারনে কেউই রাজি হলনা। কাউকে পাশে না পেয়ে শেষমেশ তিনি আমাকে একা ধরে বললেন-” বুঝলা মিয়া এই দেশের সব কয়টা মাল হলো জানোয়ার, ভালো কাজে কেউ নেই। আরে মানব বন্ধন কি আমার একার জন্য নাকি। সবার জন্যই তো। এমন না যে আমি বাড়ি যাবো বাইকে। সব শালা স্বার্থপর। এদের জন্য কিছু করার চেয়ে রাস্তার ন্যাংটা কুকুরদের জন্য কিছু করা ভালো। বিড়াল কুকুর আজন্মকাল থেকেই জামা কাপড় পড়ে না। তাদের কে ন্যাংটা বলবার যৌক্তিক কারন মাথায় এলো না। তবে বাশার ভাই কে শান্ত করবার জন্য আমি বললাম- “ভাই কেউ কিছু না করুক আপনি একা কিছু করেন। একটা বড় কালার পেপারে we want bike back, we want drive লিখে অফিস শেষ করে মিনিট পাচেকের জন্য দাড়াবেন। আমি সুন্দর করে ছবি তুলে দেব। এরপর সেটা আপনি ফেসবুকে আপলোড করে দেবেন। একটা আলোড়ন হবে। সবাই বুঝবে কেউ কিছু না করলেও একার ইচ্ছাতেও অনেক কিছু হয়। “
স্বান্তনা সূচক এই কথা যে উবার এতো ভালো লেগে যাবে তা আমার মাথাতেও ছিলো না। উনি বেশ সিরিয়াস হয়ে গেলেন। আমাকে বললেন -” দারুন বলেছো তো। এই জন্য তোমাকে আমি চিকেন খাওয়াবো।”
অফিস শেষে চারটা পাচটা ক্লিক করে যদি চিকেন খাওয়া যায় মন্দ কি। বাশার ভাই দ্রুত কালার পেজে ব্যানার বানিয়ে ফেললেন। আমাকে সেই ব্যানারের পিক অফিস আওয়ারে মেইল করলেন। আমি দেখে মনে মনে হাসলাম। এই লোকটা কাজে খামতির জন্য সকালেই ঠেলা খেয়েছে এখন সে কাজ বাদ দিয়ে আছে ব্যানার নিয়ে। অফিসের সবাই বের হলে আমরাও হলাম। নিজেদের অফিসের লোকেদের সামনে ব্যানার নিয়ে দাঁড়ানো যাবেনা তাতে হাসাহাসির একটা রোল উঠবে। ফেসবুকে হাসা হাসি হলে কমেন্ট ডিলিট করে তা সামাল দেয়া যাবে, ইন্সট্যান্ট হাসা হাসি ঠেকানো যাবেনা। এই জন্যই আমরা চায়ের দোকানে এসে ঢুকেছি। বাশার ভাই একা একা জ্বালাময়ী সব কথা বলছেন, আমার তনু মন বিটিভিতে নিবদ্ধ, তার আলাপ আমার তেমন কানে ঢুকছে না। যে মেয়েটা উপস্থাপনা করছে তার রেশমি চুল বার বার সামনে চলে আসছে, এতো সুন্দর করে সে সেই চুল সরাচ্ছে যে দেখতে দারুন লাগছে। এরমাঝেই বাশার ভাই এর অতি উত্তেজিত কথা শুনতে পেলাম- তিনি বলছেন “দেশ অচল হয়ে যাবে, সব বাইকার রা দেশ অচল করে দেবে, বাইক বন্ধ করে দেবে আর দেশ অচল হবেনা তা হবেনা।”
তাস পেটানো এক যুবক তখন বলল-“দেশে ভোটই নাই হয়ে গেলো দেশ অচল হলো না আর এটা তো বাইক।”
আরিফ ভাই কিছুদিন সরকারি একটা প্রজেক্টে কাজ করছেন তার মাঝে সরকারের উপির খানিকটা মায়া সর্বদায় কাজ করে তিনি বলে উঠলেন- ওই মিয়া ভোট নাই কে বলেছে, আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে দেশে ভোট নাই।”
তাস পেটানো দুই যুবকও কম যায়না। তারাও কোমড় বেধে নামলো ঝগড়া করার জন্য। ঠিক এই সময় বিটিভি তে বিঞ্জাপন বিরতি এলো। অগত্যা আমাকে ঘুরে দাড়াতেই হলো। বেশ কঠিন দিকে এই আলোচনা ঘুরে যাচ্ছে, সরকার দল বিরোধী দল এই দিকে কাহিনি ঘুরে যাচ্ছে দ্রুত, এই সময় দোকানি অ্যাকশনে এলেন বললেন- সবডি বাইর হো, না বাইর হইলে হোগার উপরে বারি দিয়া বাইর করুম। দেহস নাই দোকানে সাইনবোর্ড দিছি, রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ। তার হাতে দেখলাম সাপ পিটানো মোটা লাঠি। আমরা সকলেই বিল মিটিয়ে বের হয়ে এলাম। আমরা তিনজন রাস্তা পার হয়ে এসেছি। বাশার ভাই একক মানববন্ধন এর জন্য সেই পেপার বের করছেন। আরিফ ভাই সিগারেট আনার জন্য গেলেন আবার সেই দোকানে। বাশার ভাই সেই পেপার ব্যাগ থেকে বের করে হাতে নিয়েছেন। পুরোটা খুলতে পারেন নি এখনই এরমাঝেই রাস্তার এক বেওয়ারিশ কুকুর কোথা থেকে যেনো ছুটে এসে সেটা নিয়ে দে ছুট। “গেলো গেলো শুয়োরের বাচ্চা আমার জিনিস নিয়ে গেলো” বলে তিনিও ছুট দিলেন সেই কুকুরের পিছে, আরিফ ভাই সেই কুকুর কে থামানোর জন্য কাছে পিঠে একটা ইটের বড় ঢেলা তুলে নিয়ে রাস্তার ওপার থেকেই কুকুর কে লক্ষ করে ছুড়ে দিলেন, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ইট গিয়ে লাগলো বাশার ভাইয়ের বা পায়ে, বাশার ভাই হুবড়ি খেয়ে সামনে উল্টে পড়লেন। কুকুর তখন বিপদ সীমানা পার করে গেছে, সাথে সেই পেপার ও।একক মানববন্ধন এর নির্মম ইতি ঘটলো। আরিফ ভাই এসে স্যরি ভাই স্যরি ভাই করতে লাগলেন। পায়ে তীব্র ব্যাথা নিয়ে বাশার ভাই দাড়াতে পারছেন না। এরমাঝে আরিফ ভাই এর বিগলিত “স্যরি” শুনে উনার মেজাজ আরো খারাপ হল। উনি বললেল- আরিফ সাহেব আপনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হন, ভদ্রে ভাবে বলছি দূর হন এরপর দূর না হলে একটা ঝামেলা হবে।, আরিফ ভাই বিরস বদনে চলে গেলেন, বাশার ভাই আমাকে বললেন- তুমি আমাকে বাইক ড্রাইভ করে একটু বাসায় দিয়ে আসো কাইন্ডলী। এই অবস্থায় বাইক চালাতে পারবো না।
আমি- বাই আমি লাইসেন্স আনি নাই, পুলিস ধরলে বড় একটা টাকা কিন্তু ফাইন দিতে হবে।
বাশার ভাই আমার দিকে ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন, সেই দৃষ্টিতে হন্তারক হন্তারক ভাব আছে। তিনি আমাকে শুধু বললেন- পুলিশ যদি ধরে বলবা দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে উনি আহতে হয়েছেন, এক রকমের যুদ্ধই তো করতে চাইছিলাম।
আমি বহু কষ্টে হাসি চেপে রাখি, যে যুদ্ধ উনি করতে চেয়েছিলেন সেই রকম যুদ্ধ কোন না কোন উপায়ে আমরা রোজই করি সিস্টেমের সাথে। আমি কথা না বাড়িয়ে গ্যারাজ থেকে বাইক বের করে স্টার্ট দিলাম। ঠিক সে সময় আমার মনে একটা প্রশ্ন এলো- আচ্ছা পেপার নিয়ে দৌড়ে গেলো কুকুর আর বাশার ভাই তাকে কুত্তার বাচ্চা না বলে বার বার শুয়োরের বাচ্ছা বলে গালি দিলেন কেন?