প্রমথ চৌধুরী এর একটা লেখার শুরু আছে ” বাল্যকাল হইতেই আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই”। খুব ছেলেবেলা থেকেই আমাদের দেশে শেখানো হয় মিথ্যা বলা মহাপাপ। যেহেতু শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই সেহেতু মিথ্যার মহাপাপ এর মত এলেবেলে শিক্ষা নিয়ে আমাদের ভাবলে চলে না। আমরা তাই খুব ছেলে বেলা থেকেই সত্য থেকে মিথ্যা কথা বলাতে দক্ষতার পরিচয় দেই। আমি নিজে অবশ্য তেমন মিথ্যা বলিনা। তবে যখন বলি তখন সেই মিথ্যা কে মনে হয় সত্যের বাবা। যেহেতু সেই মিথ্যা কে সত্যের চেয়েও বেশি সত্য বলে মনে হয় তাই মিথ্যা বলা নিয়ে তেমন পাপবোধ আমার মাঝে কাজ করেনা। আমি কম মিথ্যা বলি এবং এই কমের ভেতরের ম্যক্সিমাম মিথ্যা আমি বলি অফিস থেকে ছুটির জন্য অথবা হাফ অফিস করে বেড়িয়ে যাবার জন্য। কোন কারণ ছাড়াই অফিস ত্যাগ করার মাঝে এক অনাবিল সুখ আছে। এবং দস্তুর মত একটা মিথ্যা বলে অফিসের সিমপ্যাথি নিয়ে ডিউটি আওয়ারের আগে বের হয়ে আসার সময়ে যে অ্যাড্রিনালীন হরমোনের নিস:রনের সুখ আমি পাই তার তুলনা নেই। আজকে বস কে ভুজং দিয়ে বের হয়ে গেছি লাঞ্চ আওয়ারের আগেই। আজকে বলেছি ময়মনসিংহ থেকে আমার ছোট ভাই আসছে ঢাকাতে তাকে পিক করে বাসায় নিয়ে আসতে হবে। বেচারা ছোট মানুষ ঢাকা শহর চেনেনা যদি হারিয়ে যায় তাহলে কি হবে। নতুন মানুষের জন্য ঢাকা শহর সত্যই ডেঞ্জারাস। তবে আমার ছোট ভাই এই বছর অনার্স শেষ করছে, সে ঢাকা আমার চেয়ে কোন অংশেই কম চিনে তেমনটা না। আর সব চেয়ে বড় কথা সে আসছেই না। আমি আগে বের হয়ে যাচ্ছি একজন বিশেষ মানুষের সাথে দেখা করবো বলে। তার সাথে গেলো দুমাসে দেখা হয়নি। আজকে দেখা করবো, সে তার অফিস শেষ করে আসবে, আমি চাইলেই অফিস শেষ করে যেতে পারতাম কিন্ত সেই ইচ্ছেকে দমিয়ে সত্যের চেয়েও শক্তিশালী এক মিথ্যে বলে বসকে কাবু করে আমি বেড়িয়ে পড়লাম। মনের মাঝে ফুরফুরে একটা আনন্দ। ফুলের দোকান থেকে একগুচ্ছ গোলাপ কিনলাম। বাইক স্টার্ট দেবো ঠিক এই সময় আবির ভাই এর ফোনটা এলো। আবির ভাই আমার ভার্সিটির বড় ভাই। কুল ডুড। এককালে প্লে বয় টাইপ ছিল। বিয়ের পরে বদলে গেলো, আগে ডেইলি এক প্যাকেট সিগারেট খেত, বিয়ের পর সিগারেট পুরোপুরি বাদ, ভাবীর নাকি সিগারেটের কটু গন্ধ সহ্য হয়না। তিনি আগে সিনেমার শুটিংয়ের যেমন চার ঘন্টার শিফট হয় ঠিক তেমন শিফট মেনে চারটা পাচটা রিলেশন করতেন। সেই রিলেশন এর হঠাৎ ব্রেক আপ হলে বিপুল উতসাহ নিয়ে আরো দুটো নতুন রিলেশনে জড়িয়ে যেতেন। সেই মানুষ বিয়ে করে পুরো বদলে গেলো। ভাবি ছাড়া অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকায় না, সব কিছুর মাঝে তিনি ভাবীর প্রশংসা করেন, কোথাও খেতে গেছি, খাওয়া ভালো হয়েছে তিনি বলবেন-” তোর ভাবীর রান্নাও সেইম এমন ভালো হয়।” কোন সিনেমা দেখা হল, নায়িকা বেশ সুন্দরী তিনি বলবেন ” তোর ভাবীও যখন হাসে ঠিক এই নায়িকার মত লাগে।” যেই লোক এই রুপ পরিবর্তন এর মাঝ দিয়ে যায় তার সাথে পূর্ব এর সেই হৃদ্যতা থাকবেনা এটাই স্বাভাবিক। আমারো নেই, তবে যোগাযোগ টা আছে। আমি ফোন রিসিভ করলাম- হ্যালো স্লামালিকুম ভাই।
আবির ভাই- ওলাইকুম, কোথায় তুই,
আমি- এইতো ভাই অফিস থেকে বেরহলাম। আজকের মত অফিস শেষ।
আবির ভাই- বাহ ভালোতো, এক কাজ কর আমার বাসায় চলে আয়।
আমি- অন্য একদিন ভাই, আজকে জরুরি একটা কাজ আছে।
আবির ভাই- আয় নারে ভাই, খুব দরকার আছে, মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে রে, বিপদের মাঝে আছি।
আমি- ভাই আজকের মত ছাড়েন অন্য দিন দেখা করি।
আবির ভাই- তোরা কাছের ভাই বেরাদার, তাও তোদের কাউকেই পাইনা বিপদে আপদে, আমি শেষ হয়ে গেছি রে, কেউ নাই আমার, এই সময় যদি তোরা সাপোর্ট না দিস তাহলে কিভাবে বেচে থাকি।
উনার এইরূপ ইমোশনাল কথা বার্তার সাথে আমি পরিচিত না। হয়তো মানুষটা খুব বিপদেই পড়েছে। ভার্সিটির বড় ভাই, বিপদে আপদে পাশেই ছিল। যার সাথে দেখা করবার কথা তার সাথে এতদুর আসার পিছনে উনার কিছুটা সাহায্য ছিল। তাই তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি তাকে না বলে দিয়ে আবির ভাই এর বাসার দিকে রওনা করলাম। গোলাপ ফুলের তোড়াটার দিকে তাকাচ্ছিনা, তাকালেই তার জন্য খারাপ লাগছে। একবার মনে হলো ফেলে দেই, আবার মনে হলো সাথেই রাখি, যতক্ষন সাথে আছে মনে হবে সে আমার সাথেই চলছে। আমি জ্যাম ঠেলে আবির ভাই এর বাসায় যখন পৌছালাম তখন আছরের আযান পড়ে গেছে। কলিং বেল চাপতেই উনি গেট খুলে দিলেন, যেন আমার অপেক্ষায়ই ছিলেন। তাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, একি চেহেরা হয়েছে, চোখের নিচে কালি, শুকিয়ে গেছেন অনেকটা, গাল বসে গেছে, মুখে চার পাচ দিনের না কামানো দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, পড়নে ঢিলা টাওজার আর তদ্রূপ ঢিলা গেঞ্জি। উনি আমাকে ড্রইংরুমে বসালেন, এর আগে দেখা ড্রইং রুমের সুশ্রী ভাবটা নেই, পুরো রুমটা অগোছালো হয়ে আছে। চার পাচটা অ্যাশট্রে ছড়ানো ছিটানো। তিনি কি আবার সিগারেট ধরেছেন নাকি? টি টেবিলের তাকে জ্যাক ড্যানিয়েল এর একটা বোতল দেখলাম। সোফার উপর আরাও একটা এসি ব্ল্যাক এর বোতল। বই এর র্যাকে অফিসার্স চয়েস এর আরো একটা বোতল। উনার তো ভাল উন্নতি হয়েছে দেখা যাচ্ছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম – ভাই বাসা তো পুরো বার বানায়ে ফেলেছেন, ভাবী কিছু বলে না আপনাকে?
আবির ভাই- বার কই পাইলি রে, তোর ভাবী মইরা গেছে, হারামজাদির নাম নিস না পাপ হইবো।
আমি- কি বলেন ভাই, যার জন্য জীবনের সব কিছু বদলায়ে ফেললেন তারে গালি দিচ্ছেন, কাহিনির স্টোরি টা খুলে বলেন তো। সিগারেট ছাড়ছেন, অন্য মেয়েছেলের দিকে তাকানো অফ করে দিছেন, টাইমলি বাসায় ঢুকে যাওয়া শুরু করলেন, আড্ডা বাদ দিলেন সব কিছুই বাদ দিলেন এখন ভাবীর নাম মুখে নিতে মানা করছেন কেন?
আবির ভাই- শোন তাইলে, ওর জন্য সব সুখ শান্তি বাদ দিলাম, সেই মেয়ে লাস্ট উইকে মামাতো ভাই এর সাথে কানাডা চলে গেছে, কানাডা পৌছায়ে আমাকে ফোন দিয়ে বলে ডিভোর্স পেপার নাকি রেডী করা আছে, আমি যেন সাইন করে দেই। এই *গীর জন্য প্রেম বাদ দিছি, আড্ডা বাদ দিছি, সিগারেট বাদ দিছি, ভালো একটা চাকরি হয়ছিলো বিদেশি সংস্থায় ওরে রেখে দূরে যেতে হবে বলে সেটাও বাদ দিছি, সেই হারামজাদি আমারে কিছু না বলেই ভেগে গেছে। আনি এত ভালোবাসি ওরে আর আমার সাথেই এই বেঈমানী। আমার মনে হচ্ছে সুইসাইড করি, মোটা দড়ি কিনে আনছি, কিন্ত সাহস করে উঠতে পারছিনা।
পৃথিবিতে দুটো কাজ খুব কঠিন এক হল কারাও কাছে কোন কিছু বিক্রি করা আই মিন যারা সেলসে কাজ করে, আর দুই হলো উপযুক্ত সান্ত্বনা দেয়া। আমি প্রথমটা করিনা। দ্বিতীয়টাও আমাকে তেমন একটা করতে হয়না। কিন্ত আবির ভাই কে কিছু সান্ত্বনা সুচক কথা বলা দরকার। পয়ত্রিশ বছরের একটা দামড়ার বউ ভেগে গেছে তাকে কি বলে সান্ত্বনা দেবো এটাই মাথায় আসছে না। আমি চুপ করে তার কথা শুনছি। তিনি তার ভালবাসার সব করুণ স্মৃতি শুনিয়েই চলেছেন। কতটা না ভালবাসতেন ভাবীকে, কত স্বপ্ন কত সুখের স্মৃতি, কত আবেগ, কত বিনিদ্র রজনীর রোমান্টিক আখ্যান। আমার মোটেও এই সব প্যাচাল ভালো লাগছেনা। তিনি একটানা এসব বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেলেন, এর পর বরফ আর কোক মিশিয়ে জ্যাক ডেনিয়াল এর একটা পেগ বানালেন, আমার জন্যও বানালেন একটা। আমি সেটা খাবোনা বলতেই উনি নিজের গ্লাসে সেটা ঢেলে নিলেন। অল্প সময়েই গ্লাস খালি করে ফেললেন, আবার বড় করে বানালেন সাথে সিগারেট, আমি সিগারেটও নিলাম না। তিনি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছেন, আবোল তাবোল বলা শুরু করলেন, আমার নিজের কাছে আফসোস হচ্ছে, সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটানোর কথা আর আমি বসে আছি বউ ভেগে যাওয়া পাড় মাতালের সাথে। উনি তৃতীয় গ্লাস নিলেন। সেটা অর্ধেকটা শেষ করে এইবার খাটি বাংলায় খিস্তি শুরু করলেন তার ভেগে যাওয়া প্রেয়সীকে নিয়ে। আমি তাকে থামানোর চেষ্টা করলাম না। ওয়াশ রুমে যাবার নাম করে শুধু জ্যাক ড্যানিয়েল এর বোতলটা লুকিয়ে রাখলাম। তার সাথে এসে বসে আছি, তিনি একটানা বকেই চলেছেন, বাংলা গালির এত বড় ভান্ডার তিনি নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছেন এটা আমি আগে জানতাম না। মানুষ কত প্রতিভাই যে নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখে!!। উনি কিছুটা ঠান্ডা হলে আমি চলে আসার জন্য উঠলাম, তিনি আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছেন, দরজা খোলার পরে বের হতে যাবো তখন তিনি বললেন- ” এই তোর কাছে টাকা হবে দশ হাজার”
আমি- দশ হবে না, টেনে টুনে পাচ হতে পারে। কেন লাগবে আপনার?
আবির ভাই- হ্যা লাগবে, হারামজাদি *গী আমাকে পথে বসায়ে গেছে, আমাদের জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট এ আঠারো লাখ টাকা ছিল, নিজের শখ আহ্লাদ না মিটায়ে ওরে গয়না কিনে দিছিলাম বার ভরি। যাবার আগে সব নিয়ে গেছে। আমাকে একবারে পথে বসায়ে গেছে রে। আমার এখন চাকরি ছাড়া পাচ টাকা সেভিংসও নাই।
আমি তাকে টাকাটা দিয়ে চলে আসলাম। তার এই তীব্র শোকের কারণ আমি এখন বুঝতে পারছি, শুধু মাত্র ছেড়ে চলে গেছে তাতে এতটা ভেংগে পড়ার মানুষ তিনি না, যাবার আগে পুরুষের মেইন শক্তি টাকা পয়সার এই স্ক্যামটা তাকে একেবারে ডুবিয়ে দিয়েছে। মানসিক শোক তিনি কাটিয়ে উঠবেন, জ্যাক ড্যানিয়েল তাকে সেই শোক কাটাতে সাহায্য করবে কিন্ত জ্যাক ড্যানিয়েল এর খরচ টা ম্যানাজ করাটাই কঠিন হবে। আমি তার জন্য মহান করুনাময় এর কাছে প্রার্থনা করলাম, মিথ্যা মিথ্যা প্রার্থনা না, সত্য প্রার্থনা। আবির ভাই সুখি হউন এবং আমার দেয়া টাকা দ্রুত ফেরত দিন। আমিন।