গত কয়েকদিন ধরে ভোর বেলার সূর্যটাকে দেখছিনা। ভোর বেলার সূর্যের আলাদা একটা রুপ আছে, মৃদু মোলায়েম আলো, সেই রোদে তেজ থাকে না, থাকে স্নিগ্ধতা। আর সাথে থাকে ঠান্ডা হিমেল হাওয়া। পুরো ব্যাপারটার মাঝে একটা পবিত্র পবিত্র ভাব আছে। এই স্নিগ্ধ পরিবেশে আমি বের হতাম টিউশন করাতে। সকালের এই পরিবেশ মন্দ লাগতো না। পড়ানো শেষ করে ফেরবার পথে অবন্তীর সাথে দেখা হতো। অবন্তী ভার্সিটির বাসের জন্য রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। দেখাই শুধু হতো, কথা হতো না। তবে আখিতে আখিতে অনেক কিছুই বুঝে নিতাম আমরা। সকালের টিউশনিটা বাদ চলে গেলো। এখন আমার সকালের দিকে অখন্ড অবসর। দেরী করে ঘুম থেকে উঠি। এরপর কিছুক্ষন চাকরির বই পত্র নিয়ে ধরি মাছ না ছুই জল এর মত করে খেলি। এই খেলা শেষ হয় দ্রুতই। তারপর আবার টিউশন করাতে চলে যাই। গত দুই বছর আমার এভাবেই চলছে। খুব খারাপ চলছে এমনটা বলা যাবেনা। আশে পাশের পরিচিত সবাই ধরেই নিয়েছে আমি খুব মন দিয়ে সরকারি গোলাম হবার সাধনা করছি, এবং খুব অল্পদিনেই তা হয়েও যাবো। তারা খুব আশাবাদী। কিন্ত আসল ব্যাপার আমার বুঝা হয়ে গেছে, গোলামির লাইসেন্স আমার হবে না, এরজন্য যে শ্রম সাধনা দরকার তা আমার নেই। হবে যে না এই রহস্য আমি আবার কারো কাছে রিভিলড করি না। মোটামুটি নির্বিবাদী আমার জীবন বেশ ভালোই কাটছে। মাঝে যা টেনশন সৃষ্টি করছে তা হল অবন্তী। এই মেয়েটার সাথে আমার ছয় বছরের গভীর প্রেম। এই মেয়ের আখি জুড়ে তেমন মায়া নেই, তার মাঝে মোহময় রুপ লাবন্য নেই। দেখতে শুনতে অ্যাভারেজই হবে। কিন্ত আসল ব্যাপার হল তার সাথে যে মন খুলে মিশবে সেই বুঝবে জগতের সব মায়া এই মেয়েটা একা ধারন করে আছে। আমি ছয় বছর এতেই মুগ্ধ হয়ে পড়ে আছি। কিন্তু এই পড়ে থাকা শেষ হয়েছে তিন দিন আগে। অবন্তীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। গত তিন দিন আগে সে আমার সাথে দেখা করলো জরুরি ভাবে। কঠিন সব আলোচনা হবে বলেই মনে হয় সে সাজ গোজ করে আসেনি, এরপরেও তাকে মন্দ লাগছিলো না। তার সাথে অনেকটা সময় কথা হলো। আওয়ামী লীগ আর বি এন পি বৈঠকের মতো নিস্ফল বৈঠক। তার সাথে শেষ কথোপকথন এর একটা নমুনা দিয়ে দেই
অবন্তী- তুমি তাহলে ফাইনাল ডিসিশন নিয়ে নিচ্ছো যে আমাকে বিয়ে করবে না।
আমি- এটা আবার কখন বললাম? এখন বিয়ে করা যাবে না, বাসা থেকে লাথি দিয়ে বের করে দেবে, আর পালিয়ে বিয়ে করাও যাবে না, পুলিশ কেস টেস হলে ফেসে যাবো। জেলখানা, পুলিস এই সব আমি ভয় পাই। আর তোমাকে এখন বিয়ে করে খাওয়াবো কি?
অবন্তী- খাবার চিন্তা তোমাকে করতে হবে না, আমি সেটার ব্যাবস্থা করে ফেলব, দুটা টিউশনি নিয়ে নিলে এমনি চলে যাবে। বিয়ে হয়ে গেলে আমি আমার বাসায় ম্যানাজ করে ফেলব, তারা যদি বের করেও দেয়, মাস দুয়েক ভদ্রভাবে চলার মত জায়গা, টাকা সবই আছে আমার কাছে।
আমি- তুমি বুঝছো না অনেক ঝামেলা হবে, এই ঝামেলা মেটানো আমার জন্য কঠিন। তোমার বাবা যে ধরনের মানুষ, আমি ওভার শিউর একটা কেস কাবারী করে দেবে।
অবন্তী – তুমি তাহলে বলছো আমি বিয়ে বসে যাই তাইতো?
আমি- এটা কখন বললাম? তুমি বাসায় বুঝায়ে শুনায়ে ম্যানাজ করো।
অবন্তী- সব আমিই করবো আর তুমি বসে বসে আটী বাধবা তাইতো।
এই মেয়ে এই ধরনের কড়া কথা আগে বলেনি, সেদিন কেনো যেনো রেগে ছিলো বেশি। সে আমাদের সম্পর্কের দাড়ি টেনে, আমাকে গবেট এবং আবাল এর সংকর বলে চলে গেলো। ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ে দাওয়াত টাওয়াত তেমন কাউকে করা নেই, তবুও সে বলে গেলো আমি যেনো গিয়ে তার বিয়ের পোলাও মাংস খেয়ে আসি।
সকালের টিউশনিটা বাদ যাবার পর যেমন অবসর বেড়েছে অবন্তীর সাথে সম্পর্ক ছেদ হয়ে যাওয়াতেও বেড়েছে অবসর। এতোদিন যার সাথে ভালোবাসার একটা অনুভূতি নিয়ে ছিলাম তাকে পাবো না এই ব্যাপারটা বুকে হাহাকার তুলে দেবার কথা, কিন্তু সেটাও হচ্ছেনা কোন এক কারণে। আজকে ঘুম থেকে উঠে গুরুপাচ্য খাবার খেতে ইচ্ছে করছে, এখন বেলা এগারোটা বাজে। আজকেই অবন্তীর বিয়ে। আচ্ছা হুট করে ওদের বাসায় চলে গেলে কেমন হয়, গিয়ে ভালো মন্দ খেয়ে আসলাম। শেষ দিনের বিচ্ছেদের দুঃখ ভালো খাবার দিয়ে ভুলে যাওয়া যেতো। এই সব চিন্তায় ছেদ পড়লো হিমেল ভাই এর ডাকে, তিনি এই মেসের সিনিয়র বড় ভাই, মতস্য ভবনে চাকরি করেন। তার মাঝে উগ্র স্বভাব আছে, অল্পতেই রেগে যান। তিনি গালে হাত দিয়ে আমাকে ডাক দিলেন। আমি উঠে বসলাম। উনার পিছে সিভিল ড্রেসে পুলিশ আছে তিনজন। তিনজনের একজনের হাতে হ্যান্ডকাফ, বাকী দুজনের হাতে শর্টগান। এরা আমাকে দেখে অবাক হলো, নিজেরা নিজেরা কথা বলল- “এই পোলা, এই পোলার জন্য একটা ভদ্র ঘরের সভ্য মেয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে চলে গেছে? মানিক ইনফরমেশন কোথাও গুবলেট হচ্ছে নাতো?” মানিক- “না বস, এই পোলাই, আজকাল কার মেয়েদের রুচি বোধের বড়ই অভাব, বাল ছাল পোলার লগে প্রেম ভালোবাসা করে বসে। “
প্রথম পুলিশ- এরে তুলে হাতকড়া পড়াও। নিয়ে চল থানায়, অবশ্য তুলে নিয়ে যাওয়াও ঠিক হচ্ছেনা, পালায়ে যদি যাবেই, তাহলে এ এই খানে ঝিম মেরে পড়ে আছে কেনো? সামথিং গোয়িং রং।
এদের মাঝে একজন এসে কোন কারন ছাড়াই আমার পিঠে রাম থাবড়া দিলো, দিয়ে বলল-” চল যাই থানাতে, বাকী আলাপ সেখানেই হবে।” হিমেল ভাই এর গালে হাত দিয়ে থাকার কারন বুঝতে পারলাম এবার, উগ্র মেজাজ দেখানোর কারনে হয়ত এই পুলিশই বন চটকানা দিয়েছে তাকে। তারা আমাকে পিকাপে তুলে নিলো। এলাকার মাঝে চাপ চাপ উত্তেজনা। ভদ্র সভ্য ভব্য যুবক কে পাজামা আর টি শার্ট পড়া অবস্থায় পুলিশ কেনো তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই জড় হয়েছে। পুলিশ খুব ভালো একটা কাজ করেছে আমাকে হ্যান্ড কাফ পড়ায়নি। এরা ধরেই নিয়েছে, ল্যাদা মারা এই যুবক পালাবে না। যেমন মানুষ জড় হয়েছে তাতে পুলিশ পিকআপ না হয়ে অন্য কোন যান হলে নিজের মাঝে একটা সেলিব্রিটি ভাব আসতো। এতো মানুষ জড় হয়েছে আমাকে দেখার জন্য। অল্পক্ষনেই থানার লক আপে ঢুকে গেলাম। এতো বিশ্রি কোন পরিবেশ যে হতে পারে এটা আমার ধারনার বাইরে। কাকে যেনো ধরে এনে বেদম পিটিয়েছে, সে মার খেয়ে পায়খানা করে দিয়েছে লক আপ এই। এক নেশা খোর নেশা উঠে পাগলের মতো করতে করতে সেই মল গায়ে মেখে ফেলেছে। পাশেই ছোট করে ঘেরা পিশাপ খানা, সেখান থেকে মুত্রের তীব্র গন্ধ আসছে। ছোট এই লক আপের মাঝে জনা বিশেক মানুষ আমরা। আমাকে দেখে হয়তোবা কিছুটা ভদ্র মনে হচ্ছে, তাই আমাকে কেউ ঘাটাচ্ছেনা। লক আপের শিক ধরে চুপ করে বসে আছি এক কোনে। সকালে প্রাতঃকৃত্য করা হয়নি, তীব্র বেগ এসেছে কিন্ত এই পরিবেশে তা করা যাবে না। এর চেয়ে পাজামা নষ্ট করে ফেলা ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে। ঘন্টা চারেক এই ভাবে গেলো। যারা আমাকে তুলে এনেছিলো এরাই বের করলো। করে বলল “হুদাই তোরে তুলে আনলাম, মেয়ের খোজ পাওয়া গেছে, সে বিয়ে না করার জন্য একাই পালিয়েছে, কোথায় আছে এক্সাক্ট লোকেশন জানি না অবশ্য, তুই চলে যা,। এরপর আবার একটা রাম থাবড়া পড়লো পিঠে৷ আগের সেই পুলিশটাই থাবড়া টা দিলো। এই পুলিশের মনে হয় থাবড়া রাশি। থাবড়া না দিয়ে কিছু করতে পারেনা। আমি পিঠে ব্যাথা নিয়ে মেস বাড়িতে ফিরে এলাম। মেসের মাঝে আমাকে নিয়ে চাপা কোলাহল। সেই কোলাহল উপেক্ষা করে আমি বাথরুমে গেলাম আগে, না হলে থানার লক আপ হয়ে যাবে মেস বাড়ি। ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে সবার অকৃত্রিম কৌতুহল মিটয়ে আমি নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আজকে পড়াতে যাবনা। সারাদিন অনেক ধকল গেলো। এর মাঝে একটা ভালো ব্যাপারই ঘটেছে সেটা হলো কেউ সাহস করে আমার বাসায় জানায়নি, জানালে এতোক্ষনে কান্নাকাটি, এরে ধরা, তারে ধরা, উকিল, পুলিশ, নেতা টেতা ধরা ধরি অনেক ব্যাপার হয়ে যেতো আমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য। বিছানায় শুয়ে আছি অনেকটা সময়। অবন্তীর কথা খুব মনে পড়ছে, মেয়েটা এতো ভালোবাসে আমাকে, যে আমি এক বাক্যে তাকে ছেড়ে দেবার পরেও সে বিয়ে না করে পালিয়ে গেছে। নিজের কাছে খুব ছোট মনে হচ্ছে, আমি এতো খারাপ কাজ কিভাবে করলাম, ছয় বছরের একটা সম্পর্ক কোন চেষ্টা না করে ভেঙে দিলাম। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। বেশ কিছুটা সময় একা একা আখি জল ফেললাম নীরবে তার জন্য। এরপর তাকে যে ভাবেই হোক খুজে বের করে তার সাথে আজীবনের জন্য নিজেকে জড়িয়ে নিতে হবে এই সিদ্ধান্ত নিলাম। জানি তার ফোন বন্ধ তবুও ফোন দিলাম। সত্যই তার ফোন অফ। একটা ছেলে মানুষী করতে ইচ্ছে হল। আমরা যখন সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম তখন সে আমাকে, আমি তাকে কম কল রেটের একটা সিম কিনে দিয়েছিলাম। সেই নাম্বার আমরা এখন ব্যাবহার করিনা। কেন যেন সেই নাম্বারে ফোন দিতে ইচ্ছে করলো। নাম্বার বন্ধই থাকার কথা। কিন্ত অবাক করার ব্যাপার সেটা খোলা। বার দুয়েক রিং হতেই অবন্তীর গলায় শুনলাম – কি জেল জীবন কেমন কাটলো?
আমি-জেলে যাইনি তো, থানার লক আপ অব্দি গিয়েছিলাম, তা তুমি কোথায় এখন?
অবন্তী- লক আপ আর জেল একই কথা, দুটোই কালো শিক দিয়েই তো ঘেরা। আমি কোথায় সেই খোজ তোমার না নিলেও চলবে। তুমি নিজের খবর ঠিক ঠাক রাখো। আজকে পড়াতে যাও নাই?
আমি- তুমি কোথায় সেটা বল আগে, আমাকে পুলিশ ধরেছে, ছেড়ে দিয়েছে, এই খবর তুমি পেয়ে যাচ্ছ, বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েও কিন্ত তোমার খোজ কেন কেউ পাচ্ছেনা।
অবন্তী- বাড়ির কেউ একজন সব জানাচ্ছে বলেই পাচ্ছি। আমি কোথায় সেটা জানলে কি তুমি শেরোয়ানি পড়ে আমাকে বিয়ে করতে আসবে নাকি?
আমি- আমার শেরোয়ানি নেই, তবে কোথায় আছো সেটা বললে পাঞ্জাবি পড়ে তোমাকে সত্যই বিয়ে করতে আসবো। আমি তোমাকে সেদিন না করে দিয়ে ভুল করেছি। সেই ভুল টা ঠিক করে ফেলতে চাই।
অবন্তী- বাহ রে বাহ এক বেলা লক আপে থেকে দেখি ভালোই সাহস বেড়েছে। সত্যিই আসবা নাকি?
আমি- সাহস বেড়েছে কমেছে কিনা জানিনা তবে ভালোবাসা ব্যাপারটার টান বেড়েছে। তুমি ঠিকানা দাও আমি আসছি।
অবন্তী- আমি জয়িতা আপুর বাসায়। আমার ইউনিভার্সিটির বড় আপু, তোমার সাথে একবার উনার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। পুরো ঠিকানা বলবোনা। পারলে বের করে আমাকে নিয়ে যাও। তোমার অপেক্ষায় থাকবো।
এটা বলেই সে ফোন কেটে দেয়। জয়িতা আপুর বাসা আমি চিনি না। উনার চেহারাও মনে পড়ছেনা। ঢাকা শহরে অজানা একটা মানুষের ঠিকানা চট জলদি বের করা যায়না। সময় লাগে। আমি দ্রূত পাঞ্জাবি পড়লাম। পকেটে কিছু টাকা নিয়ে আর এ টি এম কার্ডটা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। যে ভাবেই হোক জয়িতা আপুর ঠিকানা আমাকে বের করতে হবে। অবন্তী আমার জন্য বসে আছে। এই শহরে তীব্র ভালোবাসা নিয়ে খুব কম মানুষই অন্য জনের জন্য অপেক্ষা করে। অবন্তীর অপেক্ষা আমি বাড়তে দেবনা। এই মায়াময় মেয়েটার পাশে যত দ্রুত সম্ভব আমাকে পৌছাতে হবে। আমি একের পর এক ফোন করছি অবন্তী আর আমার দুজনের পরিচিত দের কে। কেউ না কেউ অবশ্যই জয়িতা আপুর ঠিকানা জানে। অন্ধকারে হাতড়ানো মতো এই ফোনকল। তবুও একজন মিলে গেলো যে আমাকে ঠিকানা টা দিল। আমি বেশ খানিকটা সময় বাদে জয়িতা আপুর বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি।
অবন্তী কে ফোন দিয়েছি৷ সে বারান্দায় এসে দাড়িয়েছে। তার পড়নে অতি সাধারণ স্যালোয়ার। বিকেলের পড়ন্ত রোদ পড়ছে তার শরীরে। এই অতি সাধারণত পোশাকেই তাকে দেবীর মত লাগছে। মনে হচ্ছে জগতের সব মায়া তাকে ঘিরে ধরেছে। খানিক বাদে এই মায়া আমাকে ঘিরে নেবে তার সাথে সাথে। অবন্তী এর এই মায়ার সাগরে আমি ডুব দেবার জন্যই আমি দাঁড়িয়ে আছি।