আপনজনের কাছে যাবার, তার সাথে সময় কাটাবার টান যে মানুষের কতটা প্রকট সেটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বাস বা রেলস্টেশনে। প্রতিটি স্থানেই ঘরের টানে আপন মানুষের টানে ছুটে চলা মানুষের আকুতি চোখে বাধে। যারা কাছের মানুষ ছেড়ে আসছে তাদের চোখে থাকে আপনজন চেড়ে আসার বেদনার জল, আর যারা যাচ্ছে তাদের চোখ ভরা খুশির ঝিলিক। ঘর ফেরা মানুষের চোখের অনিন্দ্য সুন্দর ছবি বেশ অনেকটা সময় নিয়েই দেখছি। বেদনার ছবিও আছে আশে পাশে, কিন্তু সেটা দেখছি না। সেই গুলো দেখতে ভালো লাগছেনা। চোখের আরাম বলে যে ব্যাপার আছে সেটা এই সব দৃশ্য দেখলে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তাই আনন্দ যাত্রাই দেখছি। আমি নিজেও দীর্ঘ এক যাত্রার জন্য বসে আছি। আমার নিজের যাত্রা আসলে আনন্দ যাত্রা না বিষাদ যাত্রা এটা নিজেও বুঝতে পারছিনা। আমি সকল স্বজন কে ছেড়ে দিয়ে একজন কে পাবার জন্য চলে যেতে চাচ্ছি দূরে কোথাও, আমার সাথে এই দীর্ঘ পথের যাত্রা সঙ্গী হিসেবে যে যাচ্ছে সেও আমার মতোই সকল স্বজন পরিজন ছেড়েই আসছে। দুজনের এই যাত্রা আসলে আনন্দ না বিষাদ নিয়ে আসবে আমি নিজেও জানি না। ভোরের আলো ফুটে শহর কোলাহল ব্যস্ততায় ডুবে যাবার আগেই আমি বের হয়েছি। এক কাপ ধোয়া ওঠা গরম চা আর একটা সিগারেট এর নিকোটিন শরীরে ভরে নিয়ে এই বাস স্টপেজে বসে অপেক্ষা করছি। আজ থেকে প্রায় বছর আটেক আগে তার সাথে যখন প্রথম পরিচয় তখন কি ভেবেছিলাম তাকে পাবার জন্য আমাকে সব ছাড়তে হবে, সেও হয়তো ভাবেনি তাই। সেই বয়সে এতো কিছু ভাবার অবকাশ ছিলনা। তখন আমাদের চালিত করত অপরিসীম আবেগ৷ সেই আবেগ একটা সময় কঠিন ভালোবাসাতে রূপ নিয়ে নিলো। কেউ কাউকে ছাড়া পরবর্তী জীবনটা পার করবো এমনটা কোনদিন ভাবতে পারিনি। সেই বহু বছর আগেই আমাদের কথা চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিলো যে যদি দু জনের সব কিছু প্রতিকূল হয়ে যায় তবে আমরা দুজন সেই প্রতিকূল সব ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। হয়তো প্রথম দিকে তীব্র অর্থকষ্ট হবে, তিন বেলার জায়গায় দুবেলা খাবো, শখ আহ্লাদ মেটাতে পারবো না, মনের ইচ্ছে গুলোকে দমিয়ে চলতে হবে। কিন্তু দুজন দুজন কে তো কাছে পেয়ে যাবো। সে আর আমি যদি একত্রে থাকি তাহলেই হবে, এর থেকে বড় পাওয়া এই জগত সংসারে আর কি ই বা আছে? গত কয়েক মাস ধরেই অতনুর বিয়ের কথা বার্তা চলছে তীব্র ভাবে। সে কোন ভাবেই আমার ব্যাপারে তার বাড়িতে বলে রাজি করাতে পারেনি৷ আমি নিজেও আমার বাড়িতে অতনুর কথা বলে রাজি করাতে পারিনি। এই যে বোঝাতে না পারার ব্যর্থতা, এই থেকেই বড় কঠিন এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আমি সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে এসেছি। সেও আসবে বলেছে। মেয়ে মানুষ তার জন্য সব গুছিয়ে বের হওয়াটা একটু কঠিনই বটে। আমি বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করছি। সে আসবে বলেছে। ফোনে কথাও হয়েছে বার দুয়েক। আমি নিশ্চিন্ত মনে অপেক্ষা করছি। মানুষের আনন্দ যাত্রা দেখছি। মনের মাঝে ক্ষীণ একটা আশা, দূরে কোথাও চলে যাবার পরে হয়তো দু পরিবার থেকেই মেনে নেবে আমাদের ব্যাপারটা। প্রথম প্রথম প্রেম ভালোবাসার পরিণয় কেউও মেনে নিতে চায় না, পরে ঠিকই মেনে নেয়। এই আশা বুকে নিয়ে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত বোধ এসে যাচ্ছে। অতনু ফোনে বার বার বলছে সে আসছে। তার আসতে এতো কেন সময় লাগছে? আরো বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলো। সূর্য এখন মাথার উপরে। গন গনে রোদের তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। শহর জুড়ে কোলাহল, মানুষের ব্যস্ততাময় দিন শুরু হয়ে গিয়েছে। আস্তে আস্তে স্টপেজের কাউন্টার গুলো ফাকা হয়ে যাচ্ছে। আমি একটা চেয়ারে একাকি বসে রয়েছি। সে এখনো এলো না। শেষ ফোনে সে বলল-” তুমি চিন্তা করোনা, আমি আসব।” একটা ছোট শব্দ “আসছি”, সেই শব্দের একটা অক্ষর “ছ” শুধু বদলে গিয়েছে, সেখানে “ব” বসে গিয়েছে তাতেই আমার মাঝে সংশয় অতনু আসবে তো। মনের মাঝে তীব্র এক ভয় ঢুকে গেলো অতনু যদি শেষ অব্দি না আসে তাহলে কি হবে? নেগেটিভ কোন চিন্তা করবো না যতোই ভাবছি এই চিন্তা ততোই মাথায় গেথে যাচ্ছে। চিন্তা একবারে দূর করবার জন্য সিগারেট ধরালাম। নিকোটিন মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা দূর করতে ভালো কাজে দেয়। পর পর তিনটা সিগারেট টেনে ফেললাম, মাথা থেকে চিন্তা দূর হচ্ছে না। কিছুটা সময় মন অন্য দিকে দেব বলেই অন্য যাত্রী দের দিকে দেখছি। বাচ্চা সমেত যে সকল মানুষ এসেছে এদের মাঝে আনন্দের সাথে প্রবল বিরক্তি বোধ রয়েছে বাচ্চা সামলানোর জন্য। চার পাচ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে তার বাবার কাছে আইসক্রিম এর বায়না ধরেছে, চারপাশ জুড়ে যেমন গরম, আইসক্রিম খেতে চাওয়া অস্বাভাবিক কিছুনা। ছেলের ঠান্ডার ধাত আছে বলেই সেই লোকটা আইসক্রিম না এনে তার জন্য চকোলেট কিনে আনলো, সে চকোলেট বাচ্চার হাতে দিতেই সেই বাচ্চা চোখে মুখে রাগ এনে স্পষ্ট ভাষায় বলল-” যেই জিনিস খাইনা সেটা আনছো কেন?” বলেই সেই চকোলেট সে তার বাবার মুখ বরারব ছুড়ে দিল। ছেলেটার মাঝে প্রতিভা আছে, বড় হয়ে ক্রিকেটার হবে হয়ত, দুর্দান্ত থ্রো হয়েছে, একদম লোকটার মুখে গিয়েই লেগেছে। কাউন্টার ভর্তি এতো মানুষের ভীড়ে ছোট্ট এক শিশুর থেকে এই রুপ অপমান মেনে নেয়া কঠিন, নিজের ছেলে বলেই তাকে মার্জনা করতে হবে এমনটা নয়, এই অপমানের শোধ নেয়া জরুরি। বাঙালি পুরুষদের যে অল্প কয়েকটা জায়গায় পুরুষত্ব প্রবল ভাবে জাগ্রত হয় তার মাঝে একটা হল সন্তান শাসন। লোকটা এগিয়ে এসে বাচ্চাটা কে এমন এক চড় মারলো এবং তাতে প্রবল শব্দ হলো। কাউন্টারের প্রায় সকলেই ঘুরে তাদের দিকে তাকালেন। বাচ্চাটা এই চড় খেয়েও কাদল না।মায়ের কোলে গিয়ে বসল। আমার নিজের মন বলছে এই টাইপ চড় আমি খেলে তিন দিন আমার মাথা ঘুরত, এই পিচ্চি কিভাবে সহ্য করে নিল খোদায় মালুম। পিচ্চিটার জন্য প্রবল মায়া লাগছে, মনে হচ্ছে তার গালে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করে দেই। একটা আইসক্রিম কিনে দিতেও ইচ্ছে করছে। এটা করা যাবে না। করলে মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশির মতো বাবার চেয়ে খাসির দরদ বেশি বলে মনে হবে। চুপ করে আরো কিছু সময় বসে থাকলাম। অ্যালার্ম এর মতো মাথার মাঝে আবার অতনু বেজে উঠল। আমি তাকে ফোন দিলাম, এবার তার ফোন বন্ধ। তার ছোট ভাইয়ের নাম্বার আমার কাছে আছে তাকে ফোন দিলাম সেও কেটে দিলো এবং এরপর পরই তার নাম্বারও বন্ধ হয়ে গেলো। আমি বাইরে এসে আবার সিগারেট ধরালাম। আমার হাতের আঙুল কাপছে সিগারেট ঠিক ঠাক ধরে রাখতে পারছিনা। সকাল থেকে না খাওয়া এই আমি কি শারিরীক ভাবে দুর্বল হয়ে সিগারেট ধরে রাখতে পারছিনা নাকি অতনুর চিন্তা আমার স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দিচ্ছে। বার বার ফোনে চেষ্টা করেও তাকে পেলাম না। এই ভাবে সে ফোন অফ করে রাখেনা। এতো দিনের এই সম্পর্কের মাঝে যে কয়বার কোন কারণে ফোন অফ রেখেছে তার আগে আমাকে জানিয়েছে। কি তীব্র ভালোবাসা সে আর আমি ধারণ করেছিলাম সেটা সে আর আমিই জানি। একবার রাতের বেলা এক পলক দেখবার জন্য সে ভার্সিটির হল থেকে গভীর রাতে ইমার্জেন্সি কারণ দেখিয়ে বের হয়েছে। সেদিন সে আর আমি সারা শহর হেটে হেটে পার করেছি৷ কি সব পাগলামির দিন পার হয়েছে। বহুদিন ভার্সিটির ক্যানটিনে না খেয়ে অপেক্ষা করেছে একসাথে আমি এলে খাবে তাই। তীব্র ভালোবাসা তে এতো গুলো দিন আছন্ন করে সে এখন কোথায় আছে? আমি তাকে হারাতে চাইনা। সে ও কখনো এমনটা বলেনি। আরো অনেকটা সময় তার জন্য অপেক্ষা করলাম। বহুবার ফোনে ধরবার চেষ্টা করলাম, সে এলো না। কোন ভাবেই যোগাযোগ হোলনা। কাউন্টারের শেষ বাস বেড়িয়ে গেলো। অপেক্ষমান যাত্রীদের বসার জায়গায় আমি একা বসে আছি। একটু পর কাউন্টার এর লোক এসে আমাকে তুলে দিলো। আমি বের হয়ে এলাম। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। শহরের সব বাতি জলে উঠেছে। কৃত্রিম আলোতে ভরে আছে সব রাস্তা, আমার অন্তর জুড়ে শুধুই অন্ধকার। গন্তব্যেহীন, উদ্দেশ্যহীন ভাবে আমি হেটে চলি। বুকের মাঝে চাপ ধরে থাকা এক সমুদ্র পরিমাণ ব্যাথা। শহরের ফুটপাত দিয়ে হেটে চলছি। আকাশে হঠাৎ করেই মেঘের গর্জন। উপরে তাকিয়ে দেখি কালো মেঘে আসমান ছেয়ে আছে। মেঘ নিয়ে আমার মাঝে চিন্তা নেই। আমি হাটছি। ভাবছি শেষটা এই ভাবে না হলেও তো হতো। অতনু এলো না। আকাশ ভেঙে প্রবল বিক্রম নিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো। সেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমি হাটি। অল্প ক্ষনের বৃষ্টিতেই রাস্তায় ফুটপাথে পানি জমে গেলো চোখের সামনেই, পথশিশুরা সেই জলে ঝাপা ঝাপি করে। আমি একা হেটে চলি। বৃষ্টি জলে আমার পোশাকের ময়লা ধুয়ে যায়, ঠান্ডা শীতল অনুভূতিতে ক্লান্তি উবে যায়। শরীরের ময়লাও ধুয়ে চলে যায়। গাছের পাতা, রাস্তার ফুটপাথের ময়লা ধুলা সব কিছু ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। বৃষ্টির জলে ভালোবাসা কেনো ধুয়ে যায়না? এতো তীব্র, এতো কঠিন, এতো প্রবল ভাবে ওতোপ্রোতো ভাবে কেন জড়িয়ে থাকে এটা মানুষ কে? কেন তাকে ধুয়ে ফেলা যায়না। মনের ক্লেদ, নোংরামো সব ধুয়ে ফেলা যায়, ভালোবাসা কেন পুরোপুরি ধুয়ে ফেলা যায়না? সে মনের কোন এক কোনে ঘাপটি মেরে চিরটাকাল রয়েই যায়। অতনু আজকের যাত্রায় না এলেও ঠিকই মনের এক পাশে ভালোবাসা হয়ে রয়ে যাবে শেষ অব্দি, তাকে ধুয়ে মুছে ফেলা যাবেনা। জগতের এই একটা ব্যাপারই কখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়না।