“মহীথর – হরিশংকর জলদাস”
বছর পাচেক আগে আমি একবার সরকারি গোলাম হবার চেষ্টা করেছিলাম। সেই চেষ্টা অল্পদিনেই বালির বাধের মতো ধ্বসে গিয়েছিলো। তার প্রধান কারন আমি অস্থির মতি এবং ধৈর্যহীন যুবক। সেবার বাংলা সাহিত্য প্রস্তুতি নেবার সময় তার নাম শুনি।” হরিশংকর জলদাস।” নামের মাঝেই একটা ভারী ভারী ব্যাপার আছে। আর বাংলা সাহিত্যে যারা এই যাবত কালে খানিকটা সাবলীল ধারায় বর্ণনা করে গল্প বলেন তাদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়না। সেই জন্যই সরকারি গোলাম হবার বাসনা যারা পোষন করেন তারা মাত্রই জানেন এই ধররেন পরীক্ষার প্রস্তুতি মূলক পড়াশোনা তে হুমায়ুন আহমেদ, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সত্যজিত(সাহিত্য কর্ম বিবেচনায়) বরাবরই উপেক্ষিত থাকেন। সেই সময় আমি গোগ্রাসে সুনীল, শীর্ষেন্দু, বিভুতি আর বিদেশী মাস্টারপিস গুলো পড়তাম। হুমায়ুন স্যার এর লেখা সব বই ই তখন আমার পড়া হয়ে গেছে। তো হরিশংকর জলদাসের নাম যখন দেখলাম বেশ গুরুত্ব দিয়ে লেখা তখন ভেবেছি এই লেখকও খুব সম্ভবত ভারী ভারী কিছুই লেখেন এই জন্যই তার নাম উঠে গেছে । সেই ভুল ভাঙার চেষ্টা তখন আর করি নাই। সেদিন ইন্টারনেট ঘাটছি কিছু পিডিএফ নামিয়ে নেবো বলে। সামনে হরিশংকর এর তিনটা বই এলো। কি মনে হলো আমি নামিয়ে ফেললাম। তার মাঝেই একটা বই “মহীথর”। এই বইটা অনেকটা হেলা ফেলা করে আমি পড়া শুরু করি। সম্পুর্ন অংশ আমি পড়েছি অফিসে বসে, এবং টানা পড়েছি। আমি একই সাথে মুগ্ধ বিমোহিত। কি অসাধারণ তার বর্ননা, কি দারুণ গল্পের প্লট। আর গল্পের চরিত্ররা এই সমাজের সব চেয়ে নিচু শ্রেণীর। এই শ্রেনীকে নিয়ে এর আগে এতো দারুন ভাবে কেউ কোন উপন্যাস লিখেছে কিনা আমার জানা নেই। গল্পের প্রধান চরিত্র গুরুচরন যে পেশায় একজন মেথর। অবস্থার উন্নতিতে সে হয়েছে মানব বর্জ্য টানার গাড়ির চালক। সে আবার মেথর পট্টির বড় হর্তাকর্তা। তার ব্যাক্তিত্ববোধ কিছুটা উচু দরের অন্য সব মেথর দের থেকে। অন্য সব মেথর দের মত সেও মদ খায়। আড্ডা দেয়। কাজ করে, প্রবল পরিশ্রম এর পরে গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যায়। তার ছেলে শিউচরণ যে শরীরে, গতরে, ব্যাক্তিত্ব বোধে বাবার চেয়ে পিছিয়ে এবং খানিকটা নরম মনের। মেথরের সন্তান হয়েও সে মদ ছোয় না। সিগারেট ফুকে না। মেথর পট্টির হতদরিদ্র সব কাঙাল মানুষ দের গল্প এই মহীথর। শহরের সেবা দান কারী প্রতিষ্ঠান এর অফিসারেরা তাদের কে অচ্ছুত ভাবে। তাদের সন্তানেরা স্কুলে গিয়ে পড়া লেখা করতে চাইলে সেই স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। সেই স্কুলের শিক্ষকেরা তাদের মন থেকে ঘৃণা করে। তারা কোথাও যাবার জায়গা পায়না। মানুষ কে সভ্য ভব্য রাখার জন্য, পয় পরিষ্কার রাখার জন্য তারই যে স্বজাতি দিন ভর উদয় অস্ত খেটে চলে সেই জাতিরই দিন শেষের পর দেখা যায় হাড়ি চড়ে না। মেথরের ছেলে মেথরই হবে তার দুই বেলা খাবার এর ব্যাবস্থা বর্জ্য পরিষ্কার করলে হবে এই নিশ্চয়তাও শহর সিটি করপোরেশনে পরিনত হলে চলে যায়। জীবন ভর তাদের নিশ্চিত কান্না। গরুচরণ তার বউ এবং তার ছেলে এবং ছেলের বউ এর গল্পই পুরো উপন্যাস জুড়ে প্রাধান্য পেয়েছে। সাথে অনুপ্রাণ হিসেবে এসেছে তাদেরই স্বগোত্রীয় আরো কিছু মানুষ। বছরের পর বছর ছোট এক ঘরে বাল বাচ্চা, নাতি পুতি সমেত করুন জীবনের প্রতিচ্ছবির এক অনন্য রুপ এই উপন্যাস। আমাদের দেশের অধিকাংশ লেখক ঢাকা শহর এর গল্প বলেন অথবা বলেন গ্রাম দেশের গল্প। এই দেশের প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ আর এক নগরী চট্টগ্রামের ছবিটা বেশ সুনিপুণ ভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। চট্টগ্রাম শহরের মেথর পট্টি আমি দেখি নাই। বইটা পড়ার সময় ঢাকা শহরের দয়াগঞ্জ পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিবাসের বিল্ডিং চোখের সামনে ভেসে এসেছে বার বার। যদিও বই এর গল্পের সাথে দয়াগঞ্জ ভবনের আকাশ পাতাল ব্যাবধান। ছোট একটা উপন্যাস অল্প সময়েই শেষ হয়ে যাবে। শত কষ্টের গল্পটা লেখক শেষ করে দিয়েছেন খানিকটা সুন্দর আশার গল্প দিয়ে। সমাজের এই নিচু শ্রেণীর মানুষের জীবনাচার জানাতে এবং তাদের না বলা অব্যাক্ত কান্না, খনিক সুখ দুঃখের গল্প জানার জন্য বইটা এক কথায় একটা মাস্টার পিস।
আমি হরিশংকর জলদাস এর বেশ কয়েকটা বই নামিয়ে রেখেছি। সেগুলোর বর্ননা হয়তো পরে আবার কখনো বলা যাবে।
পাদটীকা – খুব ছেলেবেলায় আমি আমার শহরের মানব বর্জ্য টানার গাড়ি দেখেছি। সেই শিশু বয়সে নোংরা টানা অনেকটা রেল গাড়ির মতো দেখতে এই গাড়ি দেখে এতো ভালো লেগেছিলো সাথে সাথে মনে হয়েছিলো ইশ! যদি এটা চালাতে পারতাম। এই ইচ্ছার কথা আমি আমার এক বন্ধুর কাছে ব্যাক্ত করতেই সে বলেছিলো ” তুই একটা আস্ত গবেট। গবেট বলেই গু টানা গাড়ি চালাতে চাস।”