Blog

হারবেনি -সাইলাস কে হকিং

অতীতে ফিরে যেতে কেমন লাগবে? যা ফেলে আসা হয় সেটা নিয়ে আমাদের মাঝে সব সময়ই কিছু আফসোস সৃষ্টি হয়, চিন্তা খেলা করে যে আগের দিন গুলোই বুঝি ভালো ছিলো অথবা, ইশ সেই সময়টা যদি একটু এই ভাবে কাজে লাগানো যেতো তাহলে বর্তমান টা বেশ সুশ্রী হতে পারতো। তবে অতীতের এই টানা পোড়েন বাদ দিলে একটু বেশি আগের চিন্তা যদি করা যায় তাহলে প্রায় সব মানুষই তার শৈশবের সময়টায় ফিরে যেতে চাইবে। বৈষয়িক ভাবনাহীন সেই সময়টা কিভাবে যেন চুড়ুই পাখির মতোই ফুরুত করে জীবন থেকে উড়াল দিয়ে দেয় কিছু বুঝে উঠবার আগে। সেই সময়টা প্রায় সকলের জন্যই বড়ো সুখের। চিন্তাহীন ভাবনাহীন, জীবনের দৌড়ে প্রথম হবার প্রবল পরিশ্রমহীন সেই দিন গুলি ফিরে পেতে প্রায় সকলেই চাইবে।

অতীত নিয়ে খানিক ভারী ভারী কথা বলবার সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। বহুকাল বাদে আজকে খনিকের জন্য মনে হয় টাইম ট্রাভেল করে আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম আমার শৈশবের সময়টায়।

খুলে বলা যাক বিষয়টা। আমি লেখা লেখি করি বেশ কয়েকবছর। গত তিন বই মেলাতে পর পর তিনটে উপন্যাস বেড়িয়েছে। অফিস সামলে লেখা লেখি করা বেশ কঠিন ব্যাপার। তবুও চেষ্টা করি। এর মাঝে কোন একটা কিছু বাজানো শিখবো এই ভাবনা থেকে গীটার ধরেছি কিছুদিন যাবত। এছাড়া পরিবার বন্ধু বান্ধব সামাজিকতা সব মানিয়ে নিয়ে সবটা মেইনটেইন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। আমি ব্রেক নিয়েছি। আমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ যেটা, বইপড়া, আমি ব্রেক নিলাম সেটা থেকে। চার পাচ মাস আমি কিছুই পড়িনি, ফেসবুকে কিছু ছোট গল্প পড়েছি আর পড়েছি খবরের কাগজ। দীর্ঘ সময় বই থেকে দূরে থেকে থেকে আমার বই এর নেশা কমেছে। আমার কাছে এরমাঝে বেশ কিছু ভালো বই এসেছে, নিজের ট্যাবেও বেড়েছে দারুণ সব বই এর পিডিএফ ভার্সন। সেগুলো যেনো ধুলো জমে হারিয়ে যেতে বসেছে। ভালো একটা অভ্যেস পুরোপুরি হারিয়ে যেতে যেতেই আমি আবার যেন ধরলাম সেটা।

অফিসে বসে আছি। কাজ টাজ নেই তেমন। সেলফোনের ছোট স্ক্রিন স্ক্রল করতে করতে বিরক্তি বোধ প্রবল আকার ধারন করেছে, ঠিক তেমন সময়েই আমার এক সহকর্মীর লকারে থাকা দুটো বই চোখে পড়লো, নির্লজ্জের মতো চেয়ে বসলাম। দুটো বইই সেবা প্রকাশনীর। এর মাঝে একটা পড়া। বাকিটা নিয়ে রাখলাম পড়বার জন্য। এক বসায় শেষ করেছি। সেবা প্রকাশনীর অনুবাদ, ঝরঝরে লেখা, কারণ এই বই গুলো মূলত কিশোর কিশোরী পাঠকদের জন্যই লেখা হয়৷ বইটা অফিসের ডেস্কটপের সামনে হাতে নিয়ে যখন পড়েছি মনে হয়েছে আমি সেই স্কুল জীবনে ফিরে গিয়েছি, যেখানে অনেক সময় বড় বই এর মাঝে এই বই গুলো লুকিয়ে নিয়ে পড়তাম, যেন বাড়ির গার্জেন কেউ না বুঝে ফেলে। তীব্র গরমের দিনে বাইরে খেলতে না গিয়ে মাঝে মাঝে বই পড়ে বিকেলটা দারুণ কাটতো। অফিসের সেন্টাল এসিতে আমাকে বইটা লুকিয়ে পড়তে হয়নি। তবে বিকেলে ছেলেবেলায় ঘরে বসে বই পড়বার অনুভূতি এসেছে। টানা পড়তে পেরেছি বলে মনে হয়েছে আমার বেশি বেশি বই পড়বার অভ্যেস বা বদঅভ্যেস এখনো হারিয়ে যায়নি। আমার বই এর রাজ্যে চাইলেই ডুবে যাওয়া যাবে সে কোন সময়। অনেক খেজুরে আলাপ হলো এবার বইটা নিয়ে কিছু বলি।

হারবেনি- সাইলাস কে হকিং

গল্পটা শুরু হয় দুই কিশোর কিশোরীকে নিয়ে যারা সদ্য তাদের মাকে হারিয়েছে। মা ছাড়া তাদের জীবনে নেমে এসেছে বিভীষিকা৷ সৎ মায়ের প্রবল অত্যাচারে অসহায় এই দুই ভাই বোন কোন রকমে টিকে রয়েছে। ইংল্যান্ডের লিভারপুল শহরে এই দুই বাচ্চা খেয়ে পড়ে বাচবার জন্য জান লাগিয়ে কাজের চেষ্টা করে চলে। ভাগ্য সহায় হয়না। শহরের তীব্র ঠান্ডার মৌসুম, আর তার থেকেও তীব্র পারিবারিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তারা পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে, দুই কম বয়সী এই ভাই বোনের দূর্ভোগ যেন পিছু ছাড়তে চায়না। কোন রকমে আশ্রয় পায় তারা, জীবনের কোমল হাতের স্পর্শ তাদের পাওয়া হয়না। প্রচন্ড পরিশ্রম, অনাহার, আদর যত্নহীন এই দুই ভাই বোনের মাঝে বোনটি টিকে যেতে পারেনা। সে অসুস্থ হয়ে মারা যায় এক হাসপাতালে। একমাত্র আপন জন হারিয়ে বেনি শোকে মুহ্যমান হয়, তবে বেশি শোক বইবার ফুসরত তার মেলেনা। তাকে আবার কাজে নেমে পড়তে হয়। কিছুদিন পর সে আশ্রয় পায় এক ধনীর দুলারি বাড়িতে। সেখান থেকে মিথ্যে চুরির দায়ে তাকে জেলে যেতে হয়। সেই দুলারি কে সে মনে মনে ভালোবাসে, তার প্রবল আক্ষেপ চুরির দায় মাথায় নিয়ে তাকে মেয়েটির সামনে থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। এরপর গল্প এগিয়ে যায়। মেঘ সরে গিয়ে আলো আসবার মতোই এক সময় বেনির জীবনে রোদের দেখা পাওয়া যায়। ততদিনে সে অবশ্য তার চেনা জানা ভরসার মানুষ দের হারিয়েছে। তীব্র দুঃখ কষ্টের মাঝেও সে অসত হয়নি, এটিই তাকে এগিয়ে নেয়।

এর বেশি বলে দিলে গল্প পুরোটাই বলা হয়ে যাবে। এই উপন্যাস পড়তে গিয়ে নগর ঢাকার কম বয়সী খেটে খাওয়া বাচ্চাদের ছবি বার বার চোখে ভেসেছে। যদিও এই নগরের খেটে খাওয়া সকল বাচ্চা ফেরেশতা সম নয়, কিছু কিছু তো হাড় বজ্জাত রয়েছে যারা তাদের থেকে কিছু না কিনলে সম্মান নষ্ট করে দেবার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। গল্পের মূল চরিত্র বেনি ঠিম তাদের উলটো।

শেষের দিকে এই উপন্যাস হয়েছে রোমান্টিক, তবে সেই রোমান্টিকতা বড়দের মতো নয়, ছোটদের উপযোগী করেই অনুদ্রিত। এক কথায় ভালো লেগেছে। শেষটা হয়েছে মিলন দিয়ে। ইদানীং একটা বড় বদ অভ্যেস ভাঙনের গল্প পড়তে ভালো লাগেনা। এই গল্পের প্রধান কিছু চরিত্র মারা গিয়েছে, সেই দুঃখের গল্প পড়ে যতটা কষ্ট পাবার কথা তা পাইনি। শৈশব কাল হলে অবশ্যই বেশ খারাপ লাগা কাজ করতো। বয়েস বেড়ে যাচ্ছে আবেগ যাচ্ছে কমে। তাই ছোট খাটো দুঃখবোধ প্রভাব ফেলতে পারেনা। হারবেনি আমার জন্য একটা পয়েন্ট হয়ে রইবে। বইয়ের দুনিয়ায় ফেরা হলো এটা দিয়ে। অদ্ভুত সুন্দর কিছু অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে, বহুকাল বাদে শৈশবে ফিরে যাবার আনন্দ পেয়েছি। হোক সেটা অল্প পরিমাণে। বেশ কিছুদিন বাদে আমার বই রিভিউ এর সিরিজ “শুধুই বই” শুরু হচ্ছে এটা দিয়ে। মাঝে মাঝে সেবা প্রকাশনীর অনুবাদ গুলো টনিকের কাজে দেয় এটা বলা যেতেই পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *