দুই বাড়ি – বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
খুব ছেলেবেলার শুক্রবারের দুপুরের পরের সময় গুলোর কথা মাঝে মাঝে মনে পরে। আমি যে সময়টার কথা বলছি সেটা নব্বই এর দশকের শেষের দিকের মানে বিংশ শতকে স্পর্শ করছে এমন সময় আরকি। সেই সময়ে বিনোদনের মাধ্যম তো তেমন ছিলো না, ছিলোনা ভুরি ভুরি টিভি চ্যানেল, ছিলো না হাতে হাতে টাচ স্ক্রিনের মুঠো ফোন। যে সব এলাকায় ডিশ লাইন পৌছেনি তখনও সে সব এলাকাতে বিটিভি ছিলো বিনোদনের এক এবং অদ্বিতীয় উৎস। বিটিভিতে দুপুরের পর খুব সম্ভবত তিনটার দিকে বাংলা সিনেমা দিত। সেই সময় বয়স কম সিনেমা ব্যাপারটা আমাকে টানতো না, কিন্তু সেই একবেলা সিনেমা দেখার জন্য যাদের বাড়িতে টেলিভিশন ছিলো সেই বাড়িতে রীতিমতো ভীড় লেগে যেত, টেলিভিশনের মালিকেরা এই ভীড় দেখে পুলকিত হতেন, গর্বে তাদের বুক ফুলে যেতো বিঘত খানেক। যত বেশি মানুষ বড়িতে সিনেমা দেখবার জন্য আসত তত বেশি পুলক অনুভব করতেন তারা। আমার নিজের অবশ্য সিনেমা টিভি নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিলো না, সেই বয়স্টা মাঠে দৌড় ঝাপ করে বেড়াবার, সিনেমা নামক বস্তু তে মজবার নয়। অবশ্য সত্যি যদি বলি রুবেলের সিনেমা হলে বেশ আগ্রহ কাজ করত। সেই সময় টম ক্রুজ, জ্যাকি চ্যান, মারভেল, ডিসি কমিকের চরিত্র দের সাথে পরিচিত না হবার দরুন রুবেল ই ছিলো এক রকম সুপার হিরো ধরনের চরিত্র, যার সিনেমায় কুংফু, ক্যারাটের কিছু প্যাচ পয়জার থাকতো। সেই বস্তু অন্য কোন নায়কের সিনেমায় থাকত না। তবে রুবেলের সিনেমা তো চলতো হঠাৎ হঠাৎ। বাকি বেশি সময়ই দেখতাম টিপিক্যাল বাংলা ছবি। নায়ক গরীব, নায়িকা ধনী। অথবা নায়কা গরীব নায়ক ধনী। কিন্তু ছবি শেষে অর্থনৈতিক অসমতা প্রেমের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে থাকতো না। চার টা ইমোশনাল সিন, তিনটে ফাইট, কয়েকটা ফ্যামিলি ড্রামা, খানা পাচেক অদ্ভুত কোমড় এবং বক্ষ দোলানো নাচেই একটা সিনেমা শেষ। অবশ্য উপস্থিত জনতা ধনী গরীবের এই অসম প্রেম বিরহে এমন মজা মজে যেতো যে মাঝে মাঝে কিছু অতি আবেগী মা,খালা, নানী, দাদী বয়সী দের সিনেমার চরিত্রের দুঃখ কষ্ট দেখে চোখের জল ফেলতেও দেখেছি। জসীম, ওমর সানী, বাপ্পা রাজ, এনারা হতদরিদ্র প্রেমিকের চরিত্রের জন্য অটো চয়েস ছিলো এরকমই মনে পড়ছে। নায়িকা দের কথা তেমন মনে পড়ছে না।
যাইহোক বাংলা ছবি নিয়ে এতো কপচানোর একটা শানে নযুল আছে। আজকে একটা বই এর রিভিউ দেবো, সেটার গল্প এক লাইনে বললে বলতে হবে “সমাজের উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রেম ভালোবাসা, আবেগ অনুভূতির গল্প।” একশ বিরাশি পাতার বই এর রিভিউ এক লাইনে দেয়াটা একধরণের গাধামি, নিজেকে তাই উচ্চ শ্রেণির জীব প্রমানের জন্য নিজের মতো করে একটা রিভিউ করছি।
বই এর নাম – দুই বাড়ি। লেখক – বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়।
বিভূতি আমার অল টাইম ফেভারিট রাইটারর্স (ওয়েস্ট বেংগল)। উনার লেখা নিয়ে যদি এটা ভালো হয়নি, ওটা বেশি মন্দ ছিলো, এটা এমন হতে পারতো, এই গুলা বলি তাহলে খুব বড় রকমের ধৃষ্টতা হয়ে যায়। গল্পের প্রধান চরিত্র নিধু, যে মোক্তারি পাশ করেছে সবে মাত্র। তার পিতা রাম রতন চৌধুরী। নামেই চৌধুরী, কর্মকান্ডে নন। তার প্রধান কর্মের একটি হল- অভাবে পড়লে লোকের থেকে পয়সা ধার করা। তাদেরই বাড়ির পাশে বাড়ি উচ্চবংশীয় ধনী লালবিহারী বাবুর বাড়ি। উনার কন্যা মঞ্জু হল গল্পের প্রধান নারী চরিত্র। পুজো উতসব পালনের জন্য লালবিহারীর পুরো পরিবার সহ গ্রামে আসেন। মঞ্জু ও আসে। পাশা পাশি বাড়ি হওয়াতে এই বাড়ি আর ও বাড়ির লোকেদের যাতায়াত হতোই। এক্ষেত্রে তেমন বিভেদ ছিলো না। নিধু তখন সদ্য কোর্টে যাওয়া ধরেছে, কাচারির সকল নিয়ম কানুন সে বুঝে উঠতে পারেনা। প্যাচ কষে কিভাবে জামিন আদায় করতে হয়, কিভাবে অন্য মোক্তার উকিলের মক্কেল নিজের করে নিতে হয় এই সব শিখছে। নিতান্তই ভদ্র গোছের এই যুবকের কাছে তাই কোর্ট তেমন পছন্দের জায়গা নয়, তবে পেটের টানে করতে হয় আর কি। ফি রোববার করে সে বাড়ি যায়, এই ভাবে একবার বাড়ি গিয়ে সে দেখে মঞ্জু নামের এক রুপসী তরুণী এসেছে। সে এমনিতেই অর্থনৈতিক ভাবে পর্যদুস্ত হবার কারনে কুকড়ে থাকে, এরপর সুন্দরী তরুনীর সামনে তার আরো হীনমন্যতা বেড়ে যায়। কিন্তু মঞ্জু মেয়েটা তেমন নয়, সে নিজে থেকেই নিধুর সাথে পরিচিত হয়, নিধুকে তার খোলস ছেড়ে বের করে আনে। নিধু মঞ্জুর উপরে অল্প দিনেই বেশ দুর্বল হয়ে যায়, সে সেটা প্রকাশ করতে পারেনা। মঞ্জু কিন্ত এই দুর্বলতা বুঝতে পারে, সে নিজেও নিধুর উপর দুর্বল। নিধু মাত্র এক দিনের জন্য আসে। বাকি ছয়টি দিন তাদের কারও তেমন ভালো লাগেনা। নিধু থাকে প্রবল কষ্টের মাঝে, কাচারির ছল চাতুরী সে ধরে উঠতে পারেনা৷ তেমন মক্কেল পায়না, আয় রোজগার নেই, খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই, নিজের মাঝে জড়তা, খুব ক্ষুদ্র মনে হয় নিজেকে তার, এরই মাঝে তার স্বভাব চরিত্র ভালো বলে কোর্ট এরই একজন তার পাতে দেয়া যায়না এমন কন্যার সাথে নিধুরে বিয়ে দেবার জন্য কখনো প্রছন্ন, কখনো প্রবল ভাবে চেষ্টা করে যায়। নিধু এই ব্যাপার গুলো ঠিক মানিয়ে নিতে পারেনা, এড়াতেও পারেনা। তবুও সপ্তাহের রোববার টা তার জন্য আনন্দের উপলক্ষ হয়ে আসে, এই একটা দিনই মঞ্জুর সাথে দেখা হয়, দু দন্ড সুখানুভূতি সে পায়। মঞ্জু তাকে একবার সরাসরি বিয়ের কথাও বলে, মঞ্জু সমগ্র সমাজ কে উপেক্ষা করে নিধুর সাথে কষ্ট করতে রাজি আছে এটাও বলে দেয়। নিধু বুঝতে পারেনা সে কি করবে, তার মাঝে সাহস নেই, ট্যাকের জোর নেই। এই ভাবে চলে কয়েকটা দিন। পুজোর ঠিক আগে আগে নাওয়া খাওয়ার অনিয়ম করে চলা নিধু কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়, তার বেশ কিছুদিন সংগা হীন অবস্থা চলে। দীর্ঘ দিন তাকে নিয়ে যমে মানুষের টানাটানি চলে। লালবিহারী বাবু অগাধে টাকা খরচ করেন তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য। একটা সময় সে সেরে ওঠে কিন্ত ততদিনে মঞ্জু হয়ে যায় অন্য জনের। সংগা হীন নিধু মঞ্জুর জন্য কোন চেষ্টা করবার সুযোগ পায়না। অচেতন, অর্ধচেতন নিধুর জন্য একা একটা মেয়ে হয়ে মঞ্জু আর কতটা কালই বা পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারবে।
টিপিক্যাল বাংলা ছবির মতো মিলন নেই এই গল্পে। তবে ধনী দরিদ্রের অবস্থা, চিন্তা ভাবনা, মননে, , জীবনাচারের একদম সত্য পার্থক্য এতো দারুন ভাবে এই গল্পে আছে সেটা আমার মত মানুষের পক্ষে অল্প কথায় বর্ননা করা কঠিন। বই এর শেষ যদি বিরহ বেদনা, কিংবা মিলন ছাড়া হয় সে ক্ষেত্রে আপনা থেকেই বেশ ব্যাথা বোধ কাজ করে। দুই বাড়ি এই বইটার ক্ষেত্রে সেই ব্যাথা বোধ একটু বেশিই করেছে আমার। তবে এই ব্যাথা বোধ টাও খারাপ না, সব সময় মধুর মিলন না হয় নাইবা হলো।