দেড় কামরার ছোট্ট একটা বাসা। চারতলার উপরে। খুব আহামরি ধরনের কিছু বা রাজপ্রাসাদ না। তবে দক্ষিণ মুখী জানালা আছে। সেই জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ভালোই আসে, আর আসে অবারিত বাতাস। গ্রীষ্মে যখন তীব্র দাবদাহ হয় তখন জানালা খুলে দিলে শরীর জুড়ানো হাওয়া আসে। জানালা দিয়ে এক প্লট দুরেই কনক্রিট এর সারি সারি বাসা বাড়ি। সেই বাসা বাড়ির জানালা দিয়ে যেমন আমার ঘরের অনেকটা দেখা যায়, তেমন আমিও সেই বাসা গুলোর অনেক কিছুই দেখতে পাই। মাঝের একটা প্লট খালি পড়ে আছে অনেক দিন। সেই জন্যই হাওয়া বাতাস, রোদ, বৃষ্টির জলের খেলাটা দেখা যায়৷ আমি এই বাসায় আছি বছর খানেক। থাকার জন্য বেশ ভালোই জায়গাটা। আজকে তীব্র না হলেও বেশ গরম ভাব আছে। কিন্ত জানালা খুলে দিতে পারছিনা। আমার বাসায় আজকে ছোট্ট করে মচ্ছব হবে। রতন আসবে কিছুক্ষনের মাঝেই। রতন হলো পুরো পুরি অ্যাম্বিশনলেস একটা ছেলে। অ্যাম্বিশাস না হয়েও পৈত্রিক ব্যাবসা বানিজ্য করে তার ভালো টাকা পয়সা হয়েছে। রতনের একটাই প্রধান সমস্যা সেটা হলো সে অতিমাত্রায় দারু প্রিয় লোক। আমরা স্কুল জীবনের বন্ধু। রতনের সাথে আমার সখ দুঃখের অনেক গল্প আছে। তবে গত তিন বছরে তার সাথে তেমন যোগাযোগ ছিলো না হাই হ্যালো ছাড়া। রতন ঠিক যতটা অ্যাম্বিশনলেস আমার মাঝে ঠিক ততোটাই অ্যাম্বিশান। যেকোন ব্যাপারই অধিক পরিমান হয়ে গেলে তা লেবু দুধের মত মিশে ফেটে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয়না। আমারো সেম অবস্থা। তবে শেষ তিন বছরে খানিকটা এগিয়েছি বলেই মেস ছেড়ে নিজের ছোট বাসা হয়েছে, হোক না সেটা ভাড়ার। এই তিন বছরে আমার একটা ছোট খাটো সিরিয়াস ধরনের রিলেশন হয়েছিলো। সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম যেমন হুট হাট জয় ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই ভেংগে গেছে। এই নিয়ে আমি তীব্র মনোঃকষ্টে ভুগছি। দুঃখের সময় সমব্যাথী দুঃখী সংগী পাওয়া অনেকটা নোবেল পুরষ্কার পাবার মতোই। কিন্ত কোন এক পূন্য কাজের দরুন তা মিলে গেলো আমার। রতন সেই মানুষ। রতন এর কেস আমার থেকেও জটীল। আমার তো প্রেম ভেংগে গেছে, আর রতনের ভেঙেছে বিয়ে। তার ফুটফুটে একটা দুই বছরের বাচ্চা ছিলো। অবিকল দেবালয়ের শিশু। সে যখন হাসত মনে হতো মুক্ত ঝরে পড়ছে। তার আধো আধো বোল যে শুনবে সেই মুগ্ধ হবে। এই শিশু কে দেখার পরে কোলে নেবার যার ইচ্ছে হবে না সে হলো জগতের সেরা তিন পাষাণ এর একজন। সেই দেবলোক এর শিশু সমেত রতন এর বউ রতন কে একা রেখে চলে গেলো তারই দূর সম্পর্কের এর ভাই এর হাত ধরে। যাবার আগে সে নিজের প্রেম কে প্রধান কারন হিসেবে না দেখিয়ে খুব ঠুনকো এক কারন দেখালো। কারণ হলো রতন তরল পানীয়ের ভক্ত। আরে ব্যাটা মুন্সি মাওলানা আর কিছু রোগগ্রস্ত ছাড়া এই বঙ্গ দেশে মাল খায়না এমন প্রবাদ পুরুষ আছে কয়জন? রতন প্রথমটাই ভেবেছিলো এক বউ গেছে তো কি হয়েছে? আর একটা জুটিয়ে নিতে কতক্ষন। কিন্ত সেই মেয়ে যখন রীতিমতো কোর্ট কাচারি করে তার একমাত্র সন্তানের কাষ্টডী পেয়ে গেলো তখন রতন এর হুশ হলো। তখন অবশ্য হাতে কাচকলা ধরা হয়েই গেছে। পূত্র শোকে রতনের পাগল হবার দশা। রতন আর আমার তখন আবার দেখা হলো দৈব নির্দেশে। এবং অল্প কদিনে সেই স্কুল লাইফের মত জানের জান পরানের পরান ধরনের মিতালি শুরু হলো। রতনের পাল্লায় পরে আমাকেও “না না খাব না খাব না” করেও সপ্তাহান্তে বার দুয়েক তরল খেয়ে নিতে হচ্ছে। আজকে সে কোথা থেকে যেনো স্পেশাল তরল আনবে। আমি তার জন্যই ঘরের জানালা দরজা বন্ধ করে অপেক্ষা করছি। রতনের সাথে তরল খাওয়ার এই অভ্যাস বাদ দেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্ত রতন এমনই এক মানুষ যে যার সমস্ত কিছুর শেষ হয় তরল দিয়ে। খুব সিরিয়াস ধরনের কথার মাঝেও রতন দারূ ঢুকিয়ে দিতে পারে। উদাহরন দেই। যেবার রতনের শ্বশুর অ্যক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি ছিলো সেবার সে দেখতে গেছে তাকে। সেই বৃদ্ধ বেচারা শেষ বয়সের এই দূর্ঘটনার ব্যাথা নিতে পারছে না। পেইন কিলার কোনো একটা কারনে তেমন কাজ করছে না। রতন খুব সিরিয়াস ভাবে ডিউটি তে থাকা কম বয়সী ইন্টার্ন ডাক্তার কে ডাকলো, এরপর বলল-” বিদেশে অনেক সময় ঠান্ডায় বেশি কাহিল হলে অথবা ইন্সট্যান্ট এনার্জির জন্য ব্যান্ডি খাওয়ানো হয়। এতে মানুষ বেশ ভালো এনার্জি পায়। আপনারা রোগী কে ব্যান্ডি দিতে পারেন। ইনফ্যাক্ট আমি এনে দিতে পারি। আপনাদের হসপিটাল এর পাশেই বার আছে। আমার চেনা জানা আছে। ফোন দিলেই দিয়ে যাবে।” অল্প বয়স্ক সেই ডাক্তার রতনের এই প্রস্তাব শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিলো সেদিন।
সেই রতন আজকে আমার এই খানে আসছে। তরল পানীয়ের সাথে আর সব যাবতীয় দব্যাদি সেই আনবে। রতনের সাথে বাধ্য হয়ে তরল খাবার একটাই সুবিধা, সেটা হল সে দুর্দান্ত সব কাবাব, সালাট, শুকনো সব খাবার নিয়ে আসে, সেই সব খাবার অমৃত সম। বেশিক্ষন বসে থাকতে হলো না। রতন এসে পড়লো। রতনের সাথে বড় একটা ব্যাগ। সেই ব্যাগ এ কি আছে আমি বুঝতে পারছি। আমি প্লেট গ্লাস রেডি রেখেছিলাম। সব কিছু খুলে খুলে রাখছি৷ মন ভালো করে দেয়া সব খাবার আছে সাথে। আমি প্রতিটি খুলে রাখছি আর চেখে দেখছি। স্বাদু সব খাবার। এর সাথে তরল না খেলেই জমে যেত এমনি। ব্যাগের নিচে এক লিটারের কোকের একটা বোতল। সেই বোতলের মাঝে হালকা খয়েরী ধরনের একটা তরল। দেশী মদ নিয়ে এসেছে হারামজাদা। বিদেশী তরলই গলা দিয়ে নামতে চায়না। এটা তো দেশি। রতন নিজে থেকেই বলল-” এটা স্পেশাল একটা জিনিস তালের রস দিয়ে বানানো। গন্ধ টা একটু কড়া কিন্ত পিনিক সেই হবে।” রতনের মতো দারু প্রিয় লোক যদি বলে কড়া তাহলে সেই মহার্ঘ বস্ত আমার মতো ছোট খাটো মানুষ যে গিলতে পারবে না এটা ধ্রুব সত্য। সব গুছিয়ে নিয়ে বোতল খোলা হল। খোলার সাথে সাথেই এমন এক গন্ধ এলো তাতে নাড়ি ভুড়ি বের হয়ে আসবে পেটের। রতন ঝটপট পেগ বানিয়ে ফেলল। এই জিনিস আমি ছুয়েও দেখবো না এমনটা ভেবে ছিলাম কিন্ত রতনের চাপা চাপি তে নাক মুখ বন্ধ করে গিলতে হলো। আমার বমি আসছে। রতন অবলীলায় পেগের পর পেগ মেরে যাচ্ছে। এই ভাবে কিছুক্ষন যাবার পর সে থামলো। খানিকটা খেয়েই আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। মনের মাঝে কেমন যেনো অনুভুতি। দুঃখরা সব ঘিরে ধরছে। রতন গাট হয়ে বসে আছে। এতোটা খেয়েও সে টিকে আছে কিভাবে?। আমার হঠাৎ করে কান্না পেয়ে গেলো। প্রেমিকা ছেড়ে গেছে এই ব্যাপারটা বার বার মনে আসছে। মনে হচ্ছে মেয়েটার নাম ধরে ডাক ছেড়ে কাদি। কান্না চাপা দিয়ে রাখছি। এত বিস্বাদ এই জিনিসটা যে স্বাদু সব প্রাণীজ আমিষ এর কাবাবও মুখে রুচছে না। রতন কিছুটা সময় ঝিম ধরে বসে থাকলো। এরপর নিজে থেকেই বড় করে আর এক পেগ বানিয়ে নিলো। আমি রতনকে না বললাম। রতন পাত্তা দিলো না। সেই গেলাস শেষ করে মিনিট খানেক পার হতেই আসল খেলা শুরু হলো। রতন শুরু করলো হাউ মাউ ধরনের কান্না। সেই কান্নার পিছে তার চলে যাওয়া স্ত্রী আছে। “অরুনিমা, অরুনিমা” বলে বাচ্চা দের মতো গড়া গড়ি দেয়া কান্না। তীব্র শব্দ যুক্ত সেই কান্না কিভাবে থামাবো তা বুঝছি না। অরুনিমার শোক কাটতে না কাটতে সে এবার শুরু করলো তার পূত্র নীলয় এর শোক। এই কান্না আরো তীব্র। তার এই কান্না আমি থামাবো কি আমার নিজেরো কান্না পেয়ে গেলো। আমারো সাবেক প্রেমিকার কথা মনে পরে গেলো। চোখ দিয়ে আমারো জল গড়িয়ে চলে। আমি কেদে যাই। কিন্তু রতনের মতো উচ্চ শব্দে না। মাঝে মাঝে ডুকরে ডুকরে কেদে উঠি তখন শব্দ হয়। এটা দেখে রতন কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল- “এই তুই কান্দোস কেনো? তোর কিসের দুঃখ?”
আমি-জাফিরার সাথে আমার দেড় বছরের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। জাফিরা আমাকে ছেড়ে গেছে তাই কান্দি।
রতন- “তোর বালের সম্পর্ক। প্রেম পীরিতি কোন সম্পর্ক হইলো। এই সব লুতুপুতু কারনে যদি ফ্যাচ ফ্যাচ করে আমার সামনে কান্দোস তাহলে তোর মাজায় লাথি মারবো। “
আমি রতনের কথার জবাব দিতে পারি না। কান্না চেপে রাখি। রতন হাউ মাউ করে কেদেই যায়। আমি নীরবে চোখের জল ফেলি। শব্দ করে কাদতে পারলে মনে শান্তি আসে। রতন যে ধরনের ছেলে আর যেমন তরল খেয়েছে তাতে তাকে বিশ্বাস করা যায়না। শক্ত লাথি দিয়ে মাজার হাড় ভেঙে দিলে তখন করার কিছু থাকবে না। আমি তাই চোখ থেকে জল ফেলি আর কাবাব খাবার চেষ্টা করি। এই ভাবে কিছুটা সময় পার হয়। কলিং বেল বাজে। কলিং বেল এর শব্দে আমার কিছুটা হুশ হয়। দরজা খুলে দেখি বাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে। তিনি দরজা দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে সব দেখেন। আমাদের টাল মাটাল অবস্থা। রতন বলে – “কোন শালা রে এই সময় ডিস্টার্ব করতে আসছে। পাছায় লাথি দিয়ে বিদায় কর।”
আমি কি বলব বুঝি না। বাড়িওয়ালা চোখে তীব্র ক্রোধ খেলা করে। সেই ক্রোধ সামলে নিয়ে তিনি শুধু বলেন-” মদ খেয়ে মাতলামির জায়গা এটা না। সামনের মাস থেকে বাসা ছেড়ে দিবা।” আমি মাথা নেড়ে সায় দেই। তার সাথে যুক্তিতর্ক দিয়ে কথা বলব সেই অবস্থা আমার নাই। আমি দরজা লাগিয়ে এসে আবার বসে পরি। ছোট করে একটা পেগ নেই। মাথার ভিতরে জাফিরা ঘোরে। তার জন্য হৃদয় জুড়ে সাইক্লোন হয়। কিন্তু তবুও কাদতে পারি না। শব্দ করে কান্না করবার স্বাধীনতা নেই আমার। শব্দ করে কাদলে রতন লাথি দেবে এই সম্ভাবনা প্রবল। আজব এই শহরে কোটি মানুষ তাদের শোক চেপে রেখে জীবন টেনে নেয়। ইচ্ছা মত শোক পালনের স্বাধীনতা আমাদের বেশিরভাগেরই নেই। বাড়িওয়ালা, না হয় কাছের মানুষ রতন এর মতো লোকেরাই আমাদের চেপে ধরে। আমারা নীরবে তাই এক বুক ভরা কষ্ট নিয়ে ঘুরি আর ভাবি আহারে জীবনটা এতো দুঃখের কেন?