Blog

এয়ারপোর্টে যে শুধু বিত্তবান দের ট্রানজিট পয়েন্ট তা কিন্তু নয়। প্রচুর নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেনীও এয়ার ট্রাভেল করে। মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপীয় অনেক দেশেই আমাদের দেশের মানুষের শ্রম ঘাম প্রয়োজন হয়। দেশত্যাগের একমাত্র বাহনই তাদের বিমান। সুতরাং এয়ারপোর্টে উচ্চবিত্ত ছাড়াও তাদের দেখা পাওয়া যায় বেশি। আমি এইসব দেখছি বেশ অনেকটা সময় ধরে। আমার সাথে আদনান এবং কানু আছে। আদনান আমাদের অফিসের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পোস্টে আছে। কানু আমাদের গাড়ির ড্রাইভার। তার থাকার কথা পার্কিং-এ। কিন্ত সে কেন আমাদের সাথে এসে দাঁড়িয়ে আছে আল্লাহ মাবুদ ই ভালো জানেন। এয়ারপোর্টের এর পার্কিং-এ প্রায়ই গাড়ির লুকিং গ্লাস, দরজার হ্যান্ডেল সহ যাবতীয় বাহ্যিক জিনিস চুরি হয়। কানুকে আমি এটাও বলেছি এরপরও সে আমাদের সাথে এসে দাড়িয়ে আছে। কানুর ভালো নাম হামিদ। কেন যে সবাই তাকে কানু বলে ডাকে তার ব্যাখ্যা নেই। কানু ডাকা তে সে যে খুব কষ্ট পায় এমনও না। কানুর গল্প বাদ দেই। আসল গল্প বলি। আমরা এসেছি আমাদের এম ডি স্যার কে রিসিভ করতে। তাকে রিসিভ করে হোটেলে পৌছে দিয়ে আমরা অফিস যাবো। এই ধরনের রিসিভিং প্রোগ্রাম এটা আমার দ্বিতীয়বার। তবে রিসিভ প্রোগ্রামের প্রধান হিসেবে প্রথম বার। আর এর আগে এতো বড় ভি আই পি আমি রিসিভ করিও নাই। আদনান এর প্রথম রিসিভিং এক্সপেরিয়েন্স হবে এটা। আদনান প্রথম শ্রেনীর গাধা টাইপের ছেলে। আমি নিজেও গাধা টাইপের। আমাদের এই দুই গাধা কে একসাথে রিসিভ করার জন্য যিনি চুজ কিরেছেন সে নিজেও একটা উচ্চমার্গের গাধা। আমাদের সাথে বিশাল বড় ফুলের তোড়া। সেটা কানু ধরে আছে। কানু আমাদের সাথে থাকার এই একটা সুবিধা হচ্ছে ফুলের তোড়া আমাদের ধরে থাকতে হচ্ছে না। আদনান এসেই গাধামি শুরু করেছে। আমাকে এসে বলেছে সে সকালে নাস্তা করে আসেনি, খিদে খিদে লাগছে তার। সে নাস্তা করতে যেতে চায়। আমি বলেছি” যাও নাস্তা করে আসো।” সে ছুটে বের হয়ে গেছে, আবার সেম মোশনে ফিরে এসেছে। এসেই বলছে-” স্যার এয়ারপোর্টে সব জিনিসের দাম প্রায় ডাবল, এক্সট্রা টাকা কি কোম্পানি পে করবে।” আমি বলেছি-” জানি না পে করবে কিনা, তবে আমি যদি হতাম তাহলে আসল টাকা টাও পে করতাম না, সকালের নাস্তা খাওয়ানো কোম্পানির দ্বায়িত্ব না। ” আদনান বেজার মুখে আবার কোথাও গেছে। সে বিরক্ত করছে খুব। অফিসে আমরা নরমালি ভাই বলি একজন আর একজন কে, সে এয়ারপোর্টে ঢুকাবার পর থেকেই স্যার স্যার করছে। আমি এটা বলতেই সে বলেছে,- “এম ডি স্যার কে তো ভাই বলা যাবেনা তাই এখন থেকেই স্যার বলা প্রাকটিস করছি।” আদনান কিছু সময় পরে আবার এলো, তার হাতে একটা কেক এর বড় প্যাকেট। সে আমার পাশে এসে দাড়ালো এবং অতি দৃষ্টিকটু ভাবে প্যাকেট ছিড়ে কেক এর ভোজ শুরু করলো। কানু হাতের থেকে ফুলের তোড়া নামিয়ে কেক নিলো। ফুলের তোড়া তে যে ধুলা লেগে যাচ্ছে এতে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আদনান আমাকেও কেক খাবার জন্য বার বার ইনসিস্ট করছে। আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম। এবং অফিসিয়াল ডেকোরাম ভুলে তাকে বললাম-” আর একবার যদি কেক খাবার কিথা বলেছো তাহলে কেক তোমার পেছন দিয়ে ভরে দেবো।” আদনান আমার কথা গায়ে মাখলো না। আগেই বলেছি গাধা টাইপ ছেলে। এই জন্যই তার অনেক কিছু গায়ে বাধে না। তবে কানু মিট মিট করে হাসছে। কানুর তেল ছুটাতে হবে। কানুর তেল ছোটানো খুব ইজি, মাস শেষে গাড়ির তেল এর ভাওচার যদি ঠিক ঠাক মিলানোর কথা বলা হয় তাতেই কানুর তিন দিনের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। সারাদিন কালঘাম ছুটতে থাকে তার। আদনান এবং কানু খুব আয়েশ করে কেক শেষ করলো। এমডি স্যারের প্লেন ল্যান্ড করার সময় অনেক আগেই পেড়িয়ে গেছে৷ তিনি আসতে এতো দেরি কেনো করছেন খোদা মালুম। তার ফোন নাম্বার আমার কাছে আছে। কিন্ত কল দেবার সাহস হচ্ছে না। আমার বিরক্ত লাগছে। মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপ থেকে খেটে খাওয়া মানুষ যারা আসছে এদের কে রিসিভ করছে যারা এরা অনেকদিন পরে তাদের দেখা পেয়ে কেদে ফেলছে কেউ কেউ। ফেক ইমোশন না। রিয়েল ইমোশন এই গুলা। তবে দীর্ঘ সময় ধরে একই রকম রিয়েল ইমোশন দেখতে ভালো লাগছে না। আদনান একটু আগে আমাকে বলেছে তার সিগারেটের টান উঠেছে, সিগারেট খাওয়া দরকার। আমি তাকে এই ব্যাপারে হেলপ করতে পারবো কিনা। আমি আমার লাইটার টা তাকে দিয়েছি, এবং বলেছি-” এই লাইটার দিয়ে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করো, আমাকে মুক্তি দাও।” আদনান হেসে ফেলেছে, এই ছেলের আসলে হয়েছে কি, চরম অপমাম জনক কথাও সে গায়ে মাখছে না। রাতে নেশা টেশা করেছে নাকি। দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের আসা যাওয়া দেখছি। এর মাঝে কিছু অনুর্ধ পয়ত্রিশ যুবক যুবতী আসছে এসেই দুইজন দুইজন কে জড়িয়ে ধরে চুমু টুমু খেয়ে জাপটা জাপটি করে এমন একটা ভাব করছে যেন এদের মাঝে আজই প্রথম এবং শেষ দেখা। এমন একটা কাপল কে দেখলাম বেশি জাপটা জাপটির কারনে মেয়েটার বুকের ওড়না খুলে পরে গেলো, পরনের কাপড়ও সরে গেলো, প্রাথমিক জাপটা জাপটি শেষ হতে ছেলেটা নিজেই সেই ওড়না তুলে পড়িয়ে দিলো। জামা ঠিক করে দিলো। এটা দেখে আমি বললাম- “আরে তোর যদি ওড়না ঠিক করে পড়াই লাগে তাহলে এই জাপটা জাপটি করার দরকার কি। বাসায় গিয়ে ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট দেখালেই পারোস। ” আমার কথা শুনে আদনান বললো-” আমি আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না, ওরা হাসবেন্ড ওয়াইফ, ওরা ইমোশন শো করতেই পারে, ভালোবাসা থেকেই করছে এটা, এতে আপনার প্রবলেম কি স্যার?”

আমি- ফিজিক্যাল ইন্টারকোর্স ও হাসবেন্ড ওয়াইফ ভালোবাসা থেকেই করে, তোমার লজিক অনুযায়ী সেটাও তাহলে সামনা সামনি পাবলিক প্লেসে করা যেতে পারে, নাকি বলো?

আদনান কিছু বলার আগেই কানু বলে উঠলো- “হক কথা বলেছেন স্যার, একশো ভাগ হক কথা, পীরিতি করবি নিজের ঘরে বইসা, এয়ারপোর্ট কি পীরিতের জায়গা।”

আদনান- কানু, আমরা যখন কথা বলবো এর মাঝে তুমি মাথা ঢুকাবা না। তোমার বেশী বাড় বেড়েছে।

আমি কিছুই বললাম না। আদনান এর মনে হয় কানু আমাকে সাপোর্ট করে কথা বলায় গায়ে লেগেছে। লাগুক। গাধাটার কোনো কিছুই তেমন গায়ে বাধে না। আমরা আরো কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে অপেক্ষা করলাম৷ এরপর এমডি স্যার কে দেখলাম। দীর্ঘ ভ্রমনের কারনে তিনি ক্লান্ত। তার সাথে বিদেশী একজন গেস্ট। আমরা স্যার কে ফুল দিয়ে ওয়েলকাল জানালাম। বিদেশী ডেলিগেট এর সাথে এমডি স্যার আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি “গ্লাড টু মিট ইউ স্যার” বলে হ্যান্ডশেক করলাম। আদনানও তাই করলো৷ কানুর ও বিদেশীর সাথে হ্যান্ডশেক করার ইচ্ছে ছিলো। আদনান কড়া চোখে তাকিয়ে তাকে নিবৃত্ত করলো। কানু আর আদনান আগে আগে যাচ্ছে। গাড়ির কাছে। আমি স্যার এর সাথে পিছে। টুক টাক ছোট ছোট কথা হচ্ছে। স্যারের একটা কথাতে আমার মাথায় বাজ পড়লো। স্যার বলছেন তার জন্য স্যুইট বুক করা হয়েছে কিনা। আমি তাকে বলতে পারছিনা যে স্যুইট বুক করবার ইনফরমেশন ছিলো না। তার জন্য পাচ তারকা হোটেল এর রুম বুক করা আছে। আর সেটা অ্যাডমিনের মিজান ভাই করেছে। স্যুট বুক করা লাগবে এই ব্যাপারটা আমার জানা নেই। আমি অবশ্য এটা বলতে পারলাম না। এড়িয়ে গেলাম। গাড়ি এসে গেছে, দুঃখের ব্যাপার গাড়ির লেফট সাইডের লুকিং গ্লাস নেই। এটা এমডি স্যার দেখেন নি। তবে বিদেশী দেখেছে, সে আমাকে এটার ব্যাপারে আস্ক করতেই আমি বললাম- “আওয়ার ড্রাইভার ইস ভেরী ইফিসিয়েন্ট, অ্যান্ড হিজ কমপিটেন্সী লেভেল ইজ ভেরি আপার ক্লাস, হি ক্যান ড্রাইভ উইদাউট লুকিং গ্লাস।” আমার কথায় বিদেশী কনভিন্স হয়েছে বলে মনে হলোনা। কানু বুঝতে পারছে গাড়িতে না থেকে এয়ারপোর্টে লাউঞ্জে থাকার ফল খুব খারাপ হয়েছে, সে আমার দিকে করুন নয়নে চাইছে, আমি যেনো এই লুকিং গ্লাসের ব্যাপারটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখি। আমি চুপ করে থাকলাম। বেশি কিছু বললে ঠেলার প্রথম ধাক্কা আমাকেই সামলাতে হবে। গাড়িতে আমরা পাচ জন যেতেই পারি, কিন্ত এমডি স্যারের সাথে গায়ে গা লাগিয়ে যাবার সাহস আমার নেই। আমরা বড় গাড়ি আনি নাই। বিদেশী যে আসবে এটা আমার জানা ছিলো না। রিসিপশন প্রোগ্রাম এর হেড হিসেবে আমারই সাথে যাওয়া উচিত কিন্তু আমি দ্রুত ক্যালকুলেশন করে ফেললাম, হোটেল এর রুম অ্যান্ড সুইট বুক করা নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছে, সাথে যে যাবে তাকে চুড়ান্ত রকমের ঠেলা খেতে হবে। স্যার এবং বিদেশী গাড়িতে উঠে পড়ার পর আমি আদনান কে ডেকে বললাম- “আদনান তুমি স্যার দের সাথে যাও, এর আগে ভি আই পি দের সাথে তো এক গাড়িতে যাও নায়, এবার যাও একটা এক্সপেরিয়েন্স হবে৷ আমি উবার নিয়ে তোমাদের পিছে পিছে আসছি। আমার না গেলেও হবে অবশ্য, স্যার কে নামিয়ে তুমি অফিসে চলে আসো না হয়।” আদনান আমার এই ভালো মানুষী বুঝতে পারেনি। সে খুশি মনে গাড়িতে উঠলো। আমি উবার ডেকে আর হোটেলে গেলাম না সরাসরি অফিসে আসলাম। পরের ঘটনা কি হয়েছে তার বিষদ ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। তবে আদনান টানা একমাস আমার সাথে কথা বলেনি। হোটেল এর রুম আর স্যুইট এর হুড়ো এম ডি স্যার এ তাকে ভালোই দিয়েছে এটা বোঝা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *