গ্রীষ্মের মধ্যদুপুর খুব অদ্ভুত সময়। কোন একটা বইয়ে পড়েছিলাম এই সময় “ভুতে মারে কিল”। আমাকে অবশ্য ভুতে কিল মারছে না। জনাকীর্ণ স্থলে বসে ভুতের চিন্তা করা অবান্তর। আমার অবশ্য খুব গরম বোধ হচ্ছে তেমনটা না। আমি বসে আছি যাত্রী ছাওনির শেডের নিচে। বর্তমান ঢাকা শহরে বেশ ছিমছাম কিছু যাত্রী ছাওনী হয়েছে। সেখানে আরামে বসে থাকা যায়। চাইলে শুয়েও থাকা যায়, যদি যাত্রীদের ভীড় না থাকে। আমি বাস মিস করেছি। নেক্সট বাস আসতে ঘন্টা দেড়েক দেরী হবে। এতটা সময় অপেক্ষা করতে হবে এটা ভেবে খারাপ লাগছিলো। কিন্ত এখন খারাপ লাগছেনা। রাস্তা দিয়ে প্রচুর গাড়ি চলছে, ফুটপাত দিয়ে হাটা মানুষও কম না। এদের দেখতে খারাপ লাগছে না। মাঝখানে কিছুক্ষন গাড়ি গুনলাম। কতগুলা গাড়ি পাস করলো, এর পর গুনলাম বাস। এই ভাবে সময়টা সুন্দর কাটছে। রিকশাও পার হচ্ছে অনেক, তবে রিকশা গুনে শান্তি নেই, এই সব অল্প গতির যান গুনতে ভাল লাগেনা। যাত্রী ছাওনি তে একদল তরুন ঢুকলো, শুধু তরুন না তরূনীও ঢুকলো। সেম এজের সব গুলা। এর মাঝে দুইটা মেয়ে পরীর মত সুন্দরী। এবং তাদের ড্রেসাপও উগ্র। আর একটা মেয়েকে দেখলাম, সে পরীর মত না হলেও বেশ সুন্দরী। এবং মার্জিত পোশাক পরিহিত। এই সব মার্জিত সুন্দরী মেয়েদের দেখলেই বুকে হাহাকার হয়। তবে যতটা মার্জিত ভেবেছিলাম আদতে সে তা না। আমার দিকে ভাল মত ঘুরে তাকাতেই দেখলাম তার হাতে আফ্রিকান বুনো বড় মাকড়সার ট্যাটু করা। গলায় ও বিকট ডিজাইন এর ট্যাটু। আমি আর সেই তরুন তরূনীর দলের দিকে তাকালাম না। হঠাত করেই যাত্রী ছাওনির সামনে একটা রিকশা আর মোটর বাইকের মাঝে বেধে গেলো। রিকশা আলার দোষ। সে ডান সাইড থেকে বামে চলে এসেছে৷ বাইকার সামলাতে না পেরে পড়ে গেছে। যে ভাবে পরেছে তাতে তার তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। কিন্তু সে পরা থেকে উঠলো অনেকটা জেমস বন্ড ছবির ড্যনিয়াল ক্রেগ এর মত। উঠেই, ফ্লাইং এক কিক রিকশা আলার দিকে৷ রিকশাওয়ালাও কম না। সেও বাংলা ছবির রুবেল। সরে গিয়ে কিক থেকে নিজেকে বাচালো। লাথিটা গিয়ে লাগলো রিকশাআলার ছিটে। ছিট ভেংগে গেলো। এবার শুরু হল আসল খেলা। দুই জনের ধুন্ধুমার মারামারি। মারামারি দেখে ছাওনির তরুন তরুনীর দল চলে গেল। আমি বেশ উতসাহ নিয়ে নড়ে চড়ে বসলাম। এই ধরনের ক্যচাল দেখবার মজা আছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বাংগালীর ফাইটিং সিন দেখার মাঝে একটা কিউট মজা আছে। মারামারি টা ঠিক জমছে না। বাইকার ছেলেটা ওয়েস্টার্ন স্টাইল ফলো করবার চেষ্টা করছে, এই জন্যই জমছে না। রিকশা ওয়ালা হল রুবেল, আলেকজান্ডার বো এর মুভি দেখা পাবলিক, তাছাড়া ঢাকা শহরে রিকশা চালায়ে খায়, তাই তার ক্ষিপ্রতা বেশি, বাইকার এর বেশিভাগ মিস হিট হচ্ছে, কিন্ত রিকশা ওয়ালা সুযোগ বুঝে যে দুম দাম কিল মারছে তা মিস হচ্ছে না। তবে বেশিক্ষন মন দিয়ে দেখা গেলোনা। এই শহরে যেকোন কিছু হলেই রিলিফের ফ্রি মাল নেবার জন্য যেমন অল্পতেই ভীড় লেগে যায় ঠিক তেমনই ভীড় লেগে গেলো। উতসুক জনতা তাদের ফাইটিং প্লেস কে রেসলিং এর রিং এর মত ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছে। মারামারি টা আমি আর যাত্রী ছাওনি তে বসে দেখতে পারলাম না। উঠে দাড়াতে হল। কম করে হলেও শ’খানেক লোক জড়ো হয়েছে, সবাই আমার মত মজা দেখছে। কেউ এগিয়ে এসে থামাচ্ছে না তাদের। রাস্তার মাঝে এরুপ সিন হলে জ্যাম লাগা স্বাভাবিক। লেগেও গেলো। অগ্যতা পুলিশ কে এগিয়ে আসতে হল। বাংলাদেশের পুলিশ অপ্রয়োজনীয় অ্যাকশন এর ব্যাপারে সর্বদাই এক্সপার্ট। এসেই রিকশাওয়ালার কান পেচিয়ে একটা রাম থাবড়া দিল। এদের নিয়মিত এই সব হিট করবার অভ্যাস আছে, এই থাবড়া তাই রিকশা ওয়ালা এড়াতে পারলোনা, বাইকার এর হিট গুলোর মত। পুলিশের অ্যাকশন দেখে বাইকার এর তেজ বাড়লো সেও একটা থাবড়া দিল। দুই দিক থেকে থাবড়া খেয়ে রিকশা ওয়ালা হতভম্ব। বাইকার বলল- স্যার এই *টির পোলা আমাকে ফেলে দিছে, এরে থানায় নিয়ে বাটাম দেন, এই সব ছোটলোকের বাচ্চাদের ডিরেক্ট গুলি করে মারা দরকার।
পুলিশ- ঐ মিয়া গালি মারায়তেছেন কেন? রাস্তার মাঝে মারামারি পাছা দিয়ে হান্দায়ে দেব।
বাইকার- আমার কোন দোষ নাই। এই রিকশা ওয়ালা মাল খেয়ে রিকশা চালায়তেছে, উলটা পালটা করে আমাকে ফেলে দিছে, আমার বাইকের যে ক্ষতি হয়ছে সেই টাকা ওরে দিতে হবে।
রিকশা ওয়ালা – স্যার আমি ঠিকই চালাইছি, হে বেশি স্পিডে আছিলো।
বাইকার- পুলিশ ভাই ওর রিকশা চেক করেন আমি সিউর ওর কাছে নেশা আছে।
দুই জনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যে পড়ে পুলিশ নিজেও কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো। তার কি মনে আল্লাহই জানে, সে বলল- “তোর রিকশা কই রে, চেক করবো। “
রিকশা ওয়ালা – স্যার কিছু নাই রিকশাত, এইটা তো স্যার মোটরের রিকশা না, যে মাল খায়া চালানো যাইবো, মাল খায়া টাল হইয়া কি প্যাডেল রিকশা চালান যায় নাকি।
পুলিশ- নাই যখন চেক দিয়া দেখি।
পুলিশ এর লোকটা অভিজ্ঞ হাতে রিকশার সিট সরালো, সিটের নিচেই আসল খেলা। বাংলার একটা বোতল। সেই বোতল অবশ্য খালি। তবে কিছু একটা পাওয়া গেছে এটাই বা কম কিসে? বোতল পাওয়া গেছে এটা দেখেই বাইকারের গলার আওয়াজের ভলিউম বাড়লো কয়েকগুন। সে বলল- নেশা করস মাদার*দ। বোতল তোর *গার মধ্যে ভরে দেয়া দরকার। টাকা ফালাবি এখন, বাইক ঠিক কইরা দিবি। রিকশা ওয়ালা পুলিশের পা চেপে ধরেছে, বাইকার সমানে গালি দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় স্পটে একজনের আবির্ভাব হল, এতক্ষন সে চুপ চাপ দেখছিল। এবার সামনে এলো। হ্যাংলা পাতলা শরীর, গায়ে ঢোলা পাঞ্জাবি, মাথার চুল মেয়েদের মত লম্বা, সেটা আবার ঝুটি বাধা, মুখে অনেক দিনের না কামানো দাড়ি। চোখের নিচে কালি, দেখে মনে হবে এ নিজেই নেশা করে। সে বলল- এটা কি ধরেনের অবিচার, পুজিবাদ এই দেশ টাকে শেষ করে দিচ্ছে। গরীব বলে এই রিকশা ওয়ালা আজকে মার খাবে, আর ক্যাপিটালিস্ট এই ধনী বেনিয়ারা শুধু মার দিয়েই যাবে। আপনারা সব মানুষ দাড়ায়ে এই অবিচার দেখবেন? চেক যদি করতেই হয় তাহলে দুই জন কেই চেক করতে হবে। আপনারা কি বলেন?”
সম্মিলিত জনতা চিতকার করে উঠে বলে- ঠিক ঠিক, দুই জনকেই চেক করতে হবে।
পুলিশ ভাব গতিক ভালো না বুঝে বাইকার কেও চেক করবার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। বাইকার পিছনে সরে দাঁড়ায় দুই পা। সে বলে- এ কেমন বিচার, রিকশার জন্য পড়ে গেলাম আমি, আর আমাকেই উলটা চেক করা, আমি কি রিকশা ওয়ালার মত বাংলা খাই নাকি, আমি শিক্ষিত মানুষ। চাকরি করি।
তার এই সব কথাতে উপস্থিত জনতার মন গলেনা, তারা চেক করতে বলে পুলিশকে। পুলিশ এগিয়ে গিয়ে তাকে চেক করে, তার পিছনের পকেটে পাওয়া যায় গাজার ছোট একটা পুরিয়া। পুলিশ- এই মিয়া খুব তাও বড় বড় বাতেলা ছাড়লা, তুমি নিজেও তো গাঞ্জুটি। দুইটারেই থানায় নিয়া যাইতে হবে।
বাইকার- স্যার এইটা আসলে আমার ফ্রেন্ড আমারে দিছে, আর গাজা খুব ক্ষতিকর কিছু তো না। ক্লিনিক্যালি সিগারেট থেকে গাজার ক্ষতি কম।
পুলিশ – ডাক্তারী থানায় গিয়া করিস। এখন চল।
বাংগালী সব সময়ই চেষ্টা করে, একা না ডুবার। তারা সাথে অন্য জন কে নিয়ে ডুবতে চায়। বাইকার বলে- স্যার পাঞ্জাবী পড়া যেই লোকের কথা শুনে চেক করলেন আমি সিউর অই হালা নিজেও নেশা করে। ওর চেহারা দেখলেই বুঝা যায় ও নেশা খোর। ওরেও চেক করা লাগবে।
পাঞ্জাবি পরা পুজিবাদ বিরোধি ছেলেটার মুখ ছোট হয়ে আসে। তবে তাকে পুলিশ চেক করেনা। বাইকার আর রিকশা ওয়ালা কে নিয়ে যায় এক সাথে। পুলিশের র্যাকার এসে পরে দ্রুতই। নিয়ে যায় রিকশা বাইক দুটোই। মানুষও যে যার যার দিকে চলে যায়।
আমি যাত্রী ছাওনি তে এসে বসি আবার। একটু পরে সেই ছেলেটাও এসে যাত্রী ছাওনি তে আমার পাশে এসে বসে। সে নিজে থেকেই কথা বলে আমার সাথে- দেখলেন তো আজকে কি ভাবে গরীব লোকটাকে উচিত বিচার পাইয়ে দিলাম। দেশটা পুজি বাদীদের হাতে চলে গেছে। আমাদের কেই পুজিবাদ কে হটিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করাতে হবে। এই দেশে কেউ খাবে কেউ খাবেনা তা হবে না তা হবে না।
আমি- ভাই কি পার্টি করেন, পড়াশোনা কোথায় করেন।
ছেলেটা – ঢাবি তে চারুকলায় আছি। আমি কমরেড।
আমি- বাহ ভালোতো, তবে বিচারটা ঠিক হলো না। রিকশা ওয়ালার দোষ ছিলো, আমি দেখেছি।
ছেলেটা – দোষ দুইজনেরই, নেশা করে ড্রাইভ করবে কেনো। এই সব নেশাখোর দের জন্যই দেশের এই হাল।
আমি কমরেডের সাথে আর কথা বাড়াই না। একটু পরে সে নিজেই বলে – আপনার কাছে লাইটার আছে?
আমি লাইটার বের করে দেই, সে সিগারেটের প্যাকেট খুলে সিগারেট বের করে, তার প্যাকেটে আমি গাজা ভরা সিগারেটের স্টিক দেখতে পাই, তাকে কিছুই বলিনা আমি। সে সিগারেট ধরিয়ে আমাকে লাইটার ফেরত দেয়। আমি শুধু ভাবি কমরেড আসলে কিসের নেশায় বিভোর কমিউনিজম নাকি সস্তা দরের গাজার নেশায়। মনে হয় কমিউনিজমের নেশাতেই বিভোর। একটু আগে বাইকার বললনা, গাজা আসলে ক্লিনিক্যালি সিগারেট থেকে কম ক্ষতিকর। হবে হয়তো কমিউনিজমই। কমিউনিউনিজমের নেশা সে সিগারেট ধোয়া দিয়ে সারা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে থাকে। আমার বাস চলে আসে। আমি উঠে পড়ি।