ভাল দিন দেখে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আমি আর রতন। রতন যাত্রার শুরুতেই জানিয়ে দিল তার পকেটে দশ টাকার একটা ছেড়া নোট ছাড়া আর কিছু নেই। আমি বললাম দরকার নেই। আমি তো আছিই। যাত্রাবাড়ী থেকে বাসে উঠলাম। বাসের সার্ভিস দেখে ভাল লাগলো। শুধু ভালো না, আসলে মুগ্ধ হলাম। একটু পর পর থেমে থেমে যাত্রী তুলছে। বহুদুর থেকেও যদি দেখে কেউ দাঁড়িয়ে আছে তাহলেও তার জন্য দাড়াচ্ছে। ভাব খানা এমন কেউ যদি বলে দাঁড়াও বাসা থেকে বের হচ্ছি মিনিট পাচেক পরে তাহলে তার জন্যও দাঁড়াবে। এই রকম যাত্রী বান্ধব বাস কমই দেখেছি। যেই তালে এটা আগাচ্ছে তাতে গাজীপুর পৌছাতে আদৌ পারব কিনা সন্দেহ আছে। আর ঢাকা গাজীপুর তো উন্নয়ন এর মহাসড়ক। রাস্তায় বসেই মরুভূমির ধুলি ঝড় দেখা যায়। একটু বৃষ্টি হলেই গ্রাম বাংলার কাদা পানি দেখা যায়৷ খানা খন্দের গর্তে চাকা পড়ে রোলার কোস্টারের ঝাকুনি ফিল করা যায়। এক কথায় একের মাঝে দশের সড়ক। আর জ্যাম ছাড়া যদি কেউ এই রাস্তা ফাকা পেয়েছে তাহলে ধরে নিতে হবে তার রাজ কপাল। আমার কপাল আগে থেকেই ফাটা তাই রাস্তা জুড়ে অগনিত গাড়ির সারি। বাসে বসে রতনের সাথে আমার তেমন কোন কথাই হচ্ছে না। রতন কানে হেডফোন গুজে বসে আছে। রাস্তার জ্যাম কিভাবে কমানো যায় এই চিন্তা করছি। চলন্ত সিড়ির মত চলন্ত রাস্তা তৈরী করবার মত একটা চিন্তা মাথায় এল। যেখানে গাড়ি গুলা রাস্তায় উঠে থাকবে আর রাস্তা একা একা চলবে। নিজের চিন্তা দেখে নিজেই অবাক হলাম। এত উর্বর মাথা নিয়েও কেন যে লাইফে শাইন করতে পারছিনা আল্লাহ মাবুদ ই জানেন। দীর্ঘ সময় চিন্তা ভাবনায় কাটল। সকাল সকাল বের হয়েছি বলেই রাস্তার জ্যাম আমার দেরী করাতে পারেনি। চৌরাস্তা থেকে নেমে অনেকটা পথ যেতে হয়। একটা সময় মানব বসতি কমে আসে। আমি মনে মনে ভাবি আসলেও কি কোন ফ্যাক্টরি আছে। তবে আরো কিছুটা যাবার পরে ভুল ভাঙলো। বেশ বড় না হলেও মোটামুটি লেভেলের একটা কারখানা আছে। কার খানার চার পাশের প্রকৃতি মনোরম। কারখানার পাশ দিয়ে ছোট একটা খাল গিয়েছে। আসার পথে তেমন মানুষ জন চোখে না পড়লেও এই দিক টাই মানুষের বসতি আছে। চায়ের দোকান আছে কয়েকটা। আরো কিছু দোকান পাট আছে। আমি রতন কে একটা চায়ের দোকানে বসিয়ে তাকে চা সিগারেট খেতে বলে ফ্যাক্টরির দিকে গেলাম। ফ্যাক্টরির গেটে দারোয়ান আমাকে আটকালো। তাকে যতই বলি যে আমার আজকে জি এম এর সাথে দেখা করবার কথা, সেই ব্যাটা বিশ্বাস করেনা। তার একটাই কথা জি এম এর সাথে যারা দেখা করতে আসে তাদের লিস্ট আগে থেকেই গেটে দেয়া থাকে। সেই লিস্টে আমার নাম নেই। তাকে ফোন করতে বললাম সে রাজি না। অগত্যা আমার সেই ভাই কেই ফোন করে বলতে হল। সেই ভাই আবার সপ্তম বারের বেলায় ফোন ধিরে আমার সমস্যাটা শুনেই রেখে দিল। ভাল মন্দ কিছু বলল না। তবে কাজ হল। মিনিট কয়েকের মাঝে ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলল। তবে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হবে। স্যার ব্যস্ত। অপেক্ষা করা জন্য আমার তেমন বড় বিষয় না৷ আর এদের ওয়েটিং রুমটাও ভাল। কয়েক মিনিট বসার পরে চা আর স্লাইস কেক দিয়ে গেল। খুব অবাক হলাম। এত আপ্যায়ন ভাল কিছুর ইংগিত করে না। আমি আমার লাইফে যতবার ভাল শুরু পেয়েছি কোন কাজে, ততবারই ততটা কঠিন ভাবে ব্যার্থতা আমাকে গ্রাস করেছে। চা কেক শেষ করে অল্পক্ষনেই ডাক পড়ল। আমি জি এম এর রুমে ঢুকলাম। তাকে দেখেই মনে হল এই লোক কঠিন চিজ। মাঝ বয়সী লোক। গনেশ ঠাকুরের মত একটা ভুড়ি আছে। মাথায় চুল কম। চোখ ছোট। মুখটা হাসি হাসি। আমাকে বসতে বললেন।
জি এম- সিভি এনেছেন?
আমি- জি স্যার।
আমি তাকে সিভিটা দিলাম। তিনি নিলেন এবং একটু চোখ বুলিয়েই বললেন- “আপনি ফিলোসোফির ছাত্র।” আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
জি এম- রাশেদ কে হয় আপনার?
আমি- আমার রিলেটিভ।
জি এম- স্ট্রেঞ্জ, রাশেদ বলেছিল পরিচিত একজন।
আমি কিছু বললাম না। আমার নিজের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে আত্মীয় সজন আজকাল পরিচয় দিতে চাচ্ছে না। অবশ্য রাশেদ ভাই এর যে অবস্থা তাতে আমার মত দুই চার জন কে আত্মীয় হিসেবে না রাখাটাই উত্তম। আমি চুপ করে আছি দেখে জি এম বললেন- “আপনার পড়াশোনা যে বিষয়ে সেই বিষয় রিলেটেড কোন কাজ তো আমাদের এই খানে নেই। এমন খটমটে বিষয়ে আজকাল কেউ পড়ে নাকি। দর্শন পড়ে এখন কার জামানায় টেকা যাবেনা। আচ্ছা দর্শনের সাথে মিল দিয়ে একটা ওয়ার্ড বলেন তো।
আমি- ধর্ষণ।
শব্দটা বলেই বুঝলাম যে ভুল বলে ফেলেছি। আসলে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে।
জি এম- হা হা হা। অদ্ভুত মিল দেয়া শব্দ বললেন তো।
আমি- সরি স্যার। আসলে স্লিপ অফ টাং হয়ে গেছে।
জি এম- ইটস ওকে। আচ্ছা বলেন দর্শন শাস্ত্রের বিদ্যা কিভাবে ফ্যাক্টরি রান করতে সাহায্য করতে পারে।
আমি বাবার জন্মেও এই ধরনের প্রশ্ন শুনি নায়। আমার ধারনা ছিল চাকরি হয়েই আছে কাজ টাজ বুঝে নেব। এইচ আর অথবা অ্যাডমিন এর কোন পোস্ট এ হয়ত আমাকে নিয়ে নেবে। এখন তো এসে দেখছি আসল ব্যাপার আলাদা। আমি চুপ করে আছি দেখে উনি বললেন- “কি বলতে পারবেন না তাইতো। দোষ আসলে আপনার না। দর্শন শাস্ত্র আদতেই কোন কাজেই আসে না ফ্যাক্টরি রান করার জন্য৷ আপনার দর্শন বিদ্যা পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয়।”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এর আগেও আমি বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছি এই রকম চূড়ান্ত লেভেলের অপমান আগে হইনি।
জি এম- শোনেন আপনাকে দেবার মত কোন কাজ আসলে নেই। তারপর ও রাশেদ যেহেতু পাঠিয়েছে কিছু তো করতেই হবে। আপনি এই খানে সুপার ভাইজার হিসেবে জয়েন করতে পারেন৷ আপনার কাজ হবে লেবার খাটানো আর তাদের দেখভাল করা। বেতন সাত হাজার টাকা। দুপুরে লাঞ্চ ফ্রি। ফ্যাক্টরি তেই থাকবেন এই জন্য এক হাজার টাকা কেটে রাখা হবে।
এই থল থলে শরীরের লোকটা কি বলছে এসব। লোক খাটানো কাজ করা যেতেই পারে। সুপার ভাইজার পোস্ট ছোট সেটাও ব্যাপার না। কিন্ত ছয় হাজার টাকা বেতন। আমি টিউশন করে এর চেয়ে বেশি পাই। ডাটা এন্ট্রি হিসাব করলে এই বেতনের তুলনাই আমার মান্থলী গ্রস অনেক বেশি আসে।
আমি- স্যার এত কম বেতনে তো চলা সম্ভব না।
জি এম- আপনার একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন এর থেকে বেশি ডিজার্ভ করেনা। তাছাড়া আপনাকে নিতে হবে এমনটাও না। রাশেদ বলেছে তাই একটা সুযোগ দেয়া এই আর কি।
আমি- তারপরও এই বেতনে কাজ করা সম্ভব না।
জি এম- দর্শন এর বিদ্যা নিয়ে এর চেয়ে বেশি আশা৷ করাটাও বোকামি। করলে করেন না করলে চলে যান। আপনাকে আর সময় দিতে পারছি না।
আমি কথা বাড়াই না। সালাম দিয়ে বের হয়ে আসি। মূল ফটক পার হতেই রাশেদ ভাই এর ফোন। রিসিভ করলাম। উনি বললেন-” এই তুমি চাকরি করবা না তাহলে আমাকে বলেছো কেন?”
আমি- ভাই ছোট পোস্ট। বেতন খুবই কম।
রাশেদ- তো তুমি কি জি এম পোস্ট এ জয়েন করবা। বেতন শুরুতে কমই থাকে।
আমি- ভাই এটা বেশি কম।
রাশেদ- তোমাকে এক লাখ টাকা প্রোভাইড করা লাগবে তাইনা। গাধা কোথাকার। তোমাদের মত ছেলেদের লাইফে এই জন্য কিছু হয়না। তুমি নেক্সট আমার সাথে আর কন্ট্রাক্ট করবা না।
উনি ফোন রেখে দিলেন। আজকে কি হচ্ছে বুঝছি না। সবাই শুধু হিউমিলিয়েট করছে। ফোন পকেটে ঢুকাবার আগেই রতন এর ফোন আসল। ধরতে গিয়েও ধরলাম না। কেটে দিলাম। আচ্ছা আজকে সারাদিন আমি শুধু হিউমিলিয়েট কেন হব। রতন কেও একটু ভাগ দেয়া যাক। তাহলে সাম্যাবস্থা ক্রিয়েট হবে। জগত চলে ইকুইলিব্রিয়াম এর উপর বেস করে। আমি একজন থেকে অপমান হব, আমি অন্য কে করব, সে করবে অন্য কে। আমাকে একজন বিপদে ফেলবে, আমি ফেলব আর একজন কে। এই ভাবেই চক্র চলতে থাকবে। আমি ঠিক করলাম রতন কে আমি নিয়ে যাবনা সাথে করে। ওর কাছে টাকা নাই বলেছে, ঢাকা ফেরা ওর জন্য কঠিন হবে। রতনের শিক্ষার দরকার আছে ফুটো পকেট নিয়ে লোকের ভরসায় বেড়িয়ে পড়বার মাশুল তাকে দিতেই হবে৷ রতন কে বিপদে ফেলতে পারছি দেখে রাশেদ আর জি এম এর থেকে পাওয়া অপমান এর জ্বালা কিছুটা জুড়ালো। আমি রওনা হয়ে গেলাম৷ খানিক বাদে বাসে উঠেছি। রতন ফোন দিয়েই যাচ্ছে। আমি ধরছি না। রতন টেক্সট করছে দেখলাম। ১৭৯ টাকা চায়ের দোকানে বিল হয়েছে। তার কাছে বিল দেবার টাকা নায়। অন্য জন বিল দেবে বলে চা সিগারেট খেয়ে ১৭৯ টাকা বিল তুলে ফেলে যে ছেলে তাকে শিক্ষা দেবার প্রোয়োজন আছে। রতন আবার ফোন দিচ্ছে। আমি ফোনটা অফ করে দিলাম। রতন এর পরে কি ভাবে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ছিল তা আমার জানা হয়নি। এই ঘটনার পরে রতনের সাথে দেখা করিনি বেশ কিছুদিন। এড়িয়ে চলেছি তাকে। জগত সংসারে সাম্যাবস্থা আনার জন্য এই এড়িয়ে চলাটা তেমন খারাপ কিছুনা। তাই না?