Blog

এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যাদের চাহিদা খুব সীমিত। একেবারে নেই বল্লেই চলে। প্রচুর অর্থকড়ি করতে হবে, বিরাট প্রাসাদ অট্টালিকা গড়তে হবে, বড় গাড়ি করতে হবে মোট কথা জাগতিক সব বিলাসিতার উপর আগ্রহ নেই, বড় হতেই হবে এই সব ব্যাপার নিয়ে খেও খেই নেই এক কথায়। আমার ঠিক এমন পরিচিত মানুষ আছে। তার নাম রতন। রতনের এই সব জাগতিক অর্জনের ব্যাপারে তীব্র অনিহা আছে। রতন খুব উচ্চশিক্ষিত তাও না। তার শিক্ষগত যোগ্যতা উচ্চমাধ্যমিক ফেল। সে যে খুব উচ্চমার্গের ভাব গত কথা বার্তা বলে তাও না। তবে আমার আর সব পরিচিত দের মত তার মনে পৃথিবীর মাঝে কেউকাটা হবার বাসনা নেই। রতন মোটামুটি ভাল ঘরের ছেলে। তারা খুব বেশি ধনী না হলেও ঘরে তাদের অভাব নেই। তার অন্য ভাই বোনেরা সকলেই বেশ প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্য রতনই হল গবেট শ্রেণীর। বিদ্যাশিক্ষা কম, শিক্ষার ব্যাপারে তার আগ্রহ আরও কম, কাজ কর্মের ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার কর্মী দের মতই উদাসীন, এই জন্যই রতনের তেমন কিছু হলনা জীবনে। তবে রতনের বদ গুন আছে একটা। সে অতিমাত্রায় তরল পানিয়ের ভক্ত। শুকনা না, বড়ি না, গুড়া না, পাতা না, শুধু তরল। কেউ যদি বলে আমার ব্যাগের ভিতরে কেরুর একটা ছোট বোতল আছে তাহলে সেই বোতলের লোভে রতন সারা দিন তার পিছে প্রভু ভক্ত কুকুরের মত ঘুরবে। তার এই রুপ স্বভাবের জন্য বাড়ি থেকে তার হাত খরচ দেয় যতসামান্য। বাড়ির লোকের ধারণা হাতে টাকা পেয়েই রতন লাল পানি নীল পানি খেয়ে উড়িয়ে দেই। তাদের ধারনা খুব একটা অমূলক নয়। বাস্তবিকই রতন সেটাই করে। এই জন্যই রতনের হাতে নগদ টাকা পয়সার অবস্থা সব সময়ই বাড়ন্ত। তবে রতনের সব চেয়ে ভাল যে গুন সেটা হল সে লাল পানি নীল পানি এর জন্য কখনো বিপথগামী হয়না। মানে পেলে খাই না পেলে থাকি হতাশায়। যাই হোক রতনের সাথে আমার বন্ধুত্বের শুরু ক্লাস এইট থেকে। যেবার রতন ফেল করল উচ্চ মাধ্যমিক সেই বছর থেকে তার সাথে আমার দহরম মহরম কমেছে, আমার জন্য কমেছে তা নয়, রতন নিজের থেকেই কমিয়েছে। অকৃতকার্য হবার কারনে রতন নিজে থেকেই গুটিয়ে গিয়েছিল বেশ কিছুদিন এর জন্য। আমরা বন্ধু বান্ধবেরাও তেমন খোজ খবর করিনি। তখন সকলের মাথায় এক চিন্তা কোন একটা ভার্সিটি তে ভর্তি হতে হবে। আর রতনের গুটিয়ে যাওয়া কে আমরা ভেবেছিলাম সে বুঝি প্রাণপণ সপে পড়াশোনা করছে, সামনের বার পরীক্ষায় ফাটিয়ে দেবে। তবে আমাদের সকলের চিন্তা অমূলক প্রমাণ করে সে পরের বার আবার ফেল করে গেল। এবার আর গত বারের মত তার মাঝে কোনরূপ বিকার লক্ষ করা গেল না। তবে সে তার বন্ধু বান্ধবের বৃত্ত ভেংগে দিল। কারো সাথেই মন দিল খুলে মিশে না। যখন যার সাথে মিলে অল্প কিছুদিন তার সাথে বেশ হৃদতাপূর্ণ সম্পর্ক হয় আবার অল্পদিনেই সেই মানুষের প্রতি মোহ কেটে যায় সে তার থেকে দূরে চলে যায়। এরও বছর দুয়েক পরে তার মাঝে কিভাবে যেন পানীয়ের বদ খেয়াল টা ঢুকে গেল। তবে রতন ছেলে হিসেবে ভাল, সে কখনও চাপা চাপি করে না টাকা পয়সার জন্য। দিনের পর দিন ফাকা পকেট নিয়ে মুখ বেজার না করে ঘুরবার অসাধারণ দক্ষতা তার মাঝে আছে। দেখতে দেখতে আমারা ভার্সিটির পাট চুকালাম, বিদ্যাশিক্ষার সমাপ্তির পর আরো কিছু কাল কাটল। কাছের বন্ধু বান্ধব প্রায় সকলেই চাকরি, না হয় আরো অধিক বিদ্যার আশায় স্বদেশ ত্যাগ করা অথবা ব্যাবসা বানিজ্যে মন দিয়ে বিয়ে শাদী করে জীবন এক রকম গুছিয়ে নিয়েছে। চেনা জানার মাঝে রতন একাই শুধু আগের মত রয়ে গেল। ভুল বললাম, রতনের সাথে আমিও কি ভাবে যেন আটকে গেলাম। আমারো তেমন কিছুই হল না। পছন্দ মত চাকরি হল না, ব্যাবসা ব্যাপারটা মাথায় ঢুকাতে পারলাম না। আর যে বিষয় নিয়ে পড়েছি সেই বিষয়ে ভীনদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়াটা আমার মত মানুষের জন্য দস্তুর মত সাত সমুদ্রের স্থলে চৌদ্দ সমুদ্র পাড়ি দেয়া। কিছু না করে তো আর পেট চলে না। বাড়ি থেকেও তো আর এই ধামড়া বয়সে টাকা নেয়া যায়না। তাই আমার দিন চলে টিউশনি করে আর কিছু ডাটা এন্ট্রির কাজ করে। এতে যে আয় হয় তাতে আমার কায়ক্লেশে দিন গুজরান হয়। সরকারি চাকরির জন্য যে ধৈর্য দরকার তা আমার কোন কালেও ছিল না। এখনো নায়। তাই মাঝে মাঝে এরে তারে ধরে বেসরকারি চাকরির চেষ্টা করি। বন্ধু মহলের সকলেই নিজেদের মত করে ব্যস্ত থাকে তাই যে টুক টাক যোগাযোগ আছে তা রতনের সাথেই। তবে রতনও মাঝে মাঝে আমাকে এড়িয়ে চলে। হয়ত আমার সংগ সে পছন্দ করেনা অথবা আমিও তার মত ব্যর্থ মানুষ তাই আমার সাথে মিশতে তার সুখ হয়না। সে যখন এড়িয়ে যায় আমি তাকে ধরবার চেষ্টা করিনা। রতনও এটা পছন্দ করে এবং কিছু দিন নিভৃতে কাটাবার পরে সে নিজেই আবার ফিরে আসে। তবে রতন কে একবার আমি নিজে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। সেই গল্প খুব সুখের কিছু না। অবশ্য সুখের গল্পে তেমন যুত পাওয়া যায়না। তাই আজকে সেই গল্পটাই করি।

বছর দুয়েক পার হয়ে গেছে। আমি চাকরি বাকরী কিছুই করছি না। ডাটা এন্ট্রি এর কাজ আর টিউশন করে দিন কেটে যায়। বাসা থেকে চাকরি বা স্থায়ী কিছু করবার জন্য চাপ দিচ্ছে। চাপে কাজ হচ্ছে না। কারন আমার পছন্দ মত চাকরি হয়না, যে সব হয় তাতে আমার মনে শান্তি আসেনা। আমার কায়ক্লেশে দিন গুজরান হয় তবুও মনের শান্তি ব্যাপারটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ির চাপে পরে এর তার সাথে লিংক করে ইন্টারভিউ দিতে যাই। ইন্টারভিউ তেমন ভাল হয়না। এখনকার স্মার্ট এনার্জেটিক ছেলেদের সাথে আমি পেরে উঠিনা। যদিও আমি নিজেও এই যুগেরই ছেলে, তবুও কেন যে পেড়ে উঠিনা খোদাই জানেন। আমার এক দূর সর্ম্পকের আত্মিয় আছেন তার নাম রাশেদ। বেশ ভাল চাকরি করেন৷ যথেষ্ট ঠাট বাট নিয়ে থাকেন। পাচ বার ফোন দিলে একবার ধরে অনেক কষ্টে মিনিট খানেক কথা বলেন। আমি তাকে ধরলাম। বেশ কিছুদিন তার পশ্চাৎদেশে তেল মর্দনের পরে উনি আমাকে জানালেন উনি আমার জন্য একটা চাকরি ম্যানাজ করেছেন। লোকেশন গাজীপুর। একটু রিমোট এরিয়া৷ সব ব্যাবস্থা করা আছে। আমি শুধু গিয়ে ম্যানাজারের সাথে দেখা করে কবে জয়েন করব কি কি কাজ, কিছু পেপার ওয়ার্কস আছে সেগুলা বুঝে নেব। রাশেদ এর এইরুপ কথা শুনে খুব উচ্ছ্বসিত হলাম। যাক বাবা এতদিন পরে আমার একটা গতি তো হল। রিমোট এরিয়া আমার জন্য সমস্যা না। নিরিবিলি, নির্জনতা আমি পছন্দ করি। প্রথমবার অচেনা সেই স্থলে একা যাব তেমন সাহস হচ্ছেনা। কাকে নিয়ে যাওয়া যায়৷ কেউ-ই নেই যাবার মত। সবাই ব্যস্ত নিজের মত কাজ কাম নিয়ে। ফ্রি থাকার মত আছে শুধু রতন। কিন্তু রতনও এতটা পথ যেতে চাইবে না। তারপরও উপায় না দেখে আমি রতন কেই কল করলাম। রতন সন্ধ্যার দিকে এল।

রতন- ডেকেছিস কেন?

আমি- এমনি গল্প করার জন্য। বন্ধু কি বন্ধু কে ডাকতে পারে না?

রতন- ডাকতে তো পারেই। আসলে কি দরকার বলে ফেলোতো চাদু।

আমি- শোন ডাইরেক্ট কথা বলি। সামনের সপ্তাহের রবিবার ফ্রি আছোস?

রতন- আমি অলওয়েজ ফ্রিই থাকি।

আমি – তাহলে রবিবার আমার সাথে গাজীপুর চল। যাওয়া আসা খাওয়া আমার খরচ। তুই শুধু যাবি আমার সাথে। মানে সংগ দিবি এই আর কি।

রতন- না না যাব না। আগে ঘটনা খুলে বল। জামাই আদর করে নিয়ে যাবার মানুষতো তুই না। ভিতরের কাহিনি বল। সব শুনে ভাল লাগলে যাব।

আমি- কাহিনি কিছুই না। একটা চাকরির কথা হয়েছে। গিয়ে সব বুঝে আসব। প্রথম বার যাওয়া তাই একা যাবনা।

রতন- তলে তলে টেম্পু চালাও আমি জিগাইলেই হরতাল। চাকরি করবা। জয়েন দিবা, সুট বুট পরে পাট নিবা। আমি যামু না। তুই একা যাবি।

আমি- রতন আচ্ছা তোরে ঢাকা ফিরে কাচ্চি খাওয়ামু।

রতন- কাচ্ছি তে হবে না। কেরুর একটা সাতশ এম এল এর বোতল আইনা দিবি। মনে কর এইটা তোর চাকরির জন্য ট্রিট দিতাছোস।

আমি- না সাতশ এম এল অনেক দাম। ছোট টা দিমুনে। তিনশো পঞ্চাস এর টা।

রতন- হবে না। সাতশো কইছি মানে সাতশোই। ভদ্রলোক এর এক কথা।

আমি মনে মনে ভাবলাম উচ্চমাধ্যমিক ফেল রতন ও ভদ্রলোক হয়ে গেল কবে। হাতি কাদায় পড়লে পিপড়াও মজা নেয়। অবশ্য আমার যে হালত তাতে নিজেকে হাতি ভাবা ঠিক না। আমি তাই বললাম- আচ্ছা সাতশোই দিমু। কিন্তু কথা আছে। কাচ্ছি খাওয়াব না।

রতন মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে রাজি। এর পর আমরা কিছুক্ষন সুখ দুঃখের আলাপ করলাম। আসলে সব এ দুঃখের আলাপ। সুখের আলাপ আমাদের তেমন একটা নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *